রাজধানীর গণপরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং বাহনে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য তুলে ধরেন। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে চতুর্থ যাত্রী অধিকার দিবস উপলক্ষে ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংগঠনটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২০ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন গণপরিবহনে ভাড়া আদায় পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন বাস ও মিনিবাসে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশার প্রায় ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং হিউম্যান হলারে (লেগুনা) ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করে মোজাম্মেল হক বলেন, রাজধানীতে পাঁচ লাখ রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিক্যাব যাত্রী বহন করছে। এসব বাহনে একেকজন যাত্রীর কাছ থেকে গড়ে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার লক্কড়ঝক্কড় বাস ও মিনিবাসের সব কটিতেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যেখানে প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে গড়ে ১৭ টাকা বেশি ভাড়া নেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে প্রায় ১৫ হাজার বৈধ অটোরিকশা চলে। এ ছাড়া আরও প্রায় সমানসংখ্যক অটোরিকশা রাজধানীতে অবৈধভাবে চলে। এসব অটোরিকশায় প্রতি ট্রিপে গড়ে ১৪৫ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। আর আইন থাকলেও সরকার হিউম্যান হলারের (লেগুনা) ভাড়া নির্ধারণ করছে না। ফলে এ বাহনে সব সময়ই দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ হিসাবে যাত্রীদের কাছ থেকে গড়ে আট টাকা বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। রাজধানীতে যাতায়াত করা এসব যানবাহনের ট্রিপগুলোর গড় ধরে বাড়তি ভাড়া আদায়ের এই হিসাব করা হয়েছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নগরের কোনো পরিবহনে এখন সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নয়। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি গণপরিবহনে ২৫টি যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন ১০ জন যাত্রী।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের মোহাম্মদ হানিফ বলেন, সড়কে নৈরাজ্যের সব দোষ শ্রমিকের ঘাড়ে আসে। মালিক থাকেন কাচের ঘরে। সেখানে কেউ ঢিলও ছুড়তে পারে না, তাঁদের গায়ে ঢিলও লাগে না। তিনি আরও বলেন, সড়কে নৈরাজ্য এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের আঁতুড়ঘর কিন্তু বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ)। মালিক সমিতির দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির তিন ঘণ্টার মধ্যেই ভাড়া বৃদ্ধির কাজটি হয়ে যায়। অথচ ভাড়া বাড়াতে হলে কমপক্ষে এক মাস আগে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা।
পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য প্রতিরোধে যাত্রী অধিকার দিবসে ১০টি দাবি তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চাঁদাবাজি, অনৈতিক লেনদেন ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে নগদ লেনদেন বন্ধ করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে। ভাড়া নির্ধারণে মালিক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধে অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, বুয়েটের কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ লোকজন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে বাসভাড়া নির্ধারণের কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে। ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির তালিকা মাঠপর্যায়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও ক্যাবের প্রতিনিধি নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পরে চূড়ান্তভাবে ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সভায় সাংবাদিক মাসুদ কামাল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু জাফর, অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের চেয়ারম্যান রফিকুল হোসেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ও অপরাধবিষয়ক বিজ্ঞানী মোজাহেরুল হক, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল, এসএমই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান প্রমুখ বক্তব্য দেন।