ঢাকায় লার্ভা বেড়েছে তিন গুণ, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার শঙ্কা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা আছে। মশা নিয়ন্ত্রণে তারা সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ায় উদ্যোগী হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকে।

নির্মাণাধীন ভবনের চৌবাচ্চায় ছিল প্রচুর লার্ভা

ঢাকার দুই সিটিতে বর্ষা-পরবর্তী এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট জরিপে ভীতিকর ফল পাওয়া গেছে। চলতি ডিসেম্বর মাসের জরিপে দেখা গেছে, এখানকার বাড়িঘরে লার্ভার উপস্থিতি গত বছরের বর্ষাপরবর্তী সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি ঘটে বর্ষায়। এর আগের এই জরিপের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। গত বছর বর্ষা–পরবর্তী লার্ভা জরিপের পর জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল। সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। দেশে এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে।

একসময়ের ঢাকাকেন্দ্রিক এ রোগ এখন ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। ঢাকার তুলনায় এর বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবার দ্বিগুণের বেশি। এমন পরিস্থিতিতে বর্ষা–পরবর্তী সর্বশেষ জরিপের ফলাফল আসছে বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত দিচ্ছে—জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকদের আশঙ্কা এমনই।

জরিপে গতবারের চেয়ে এবার অনেক বেশিসংখ্যক বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। গতবার জরিপের ফল দেখে দুই সিটিকে সাবধান করা হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি আরও নাজুক। তাই এখনই সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ না করলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ 

দেশে ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। এ সময় মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের। চলতি বছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৯৪৫। আর মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৭০১ জনের।

সাধারণত শীত মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। স্বাভাবিকভাবে চলতি ডিসেম্বরেও (শীতে) আক্রান্ত ও মৃত্যু অন্যান্য মাসের চেয়ে কমে এসেছে। তবে এই ডিসেম্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো ডিসেম্বর মাসের চেয়ে বেশি। গত বছরের ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের বেশি, মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের ২৮ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে, মারা গেছেন ৭৯ জন।

এডিস মশা

জরিপের ফলাফল

কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, লার্ভা থেকে সাত দিনের মধ্যে কামড় দেওয়ার উপযোগী মশার জন্ম হয়। আর লার্ভার হিসাবই বলে দেয়, এডিস মশার বিস্তার কতটা হবে। এ সম্পর্কে ধারণা পেতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার (প্রাক্‌-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী) রাজধানীতে লার্ভা জরিপ করে। রাজধানীর বাইরেও  জরিপ হয়। ফলাফল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকেও দেয় তারা।  

চলতি ডিসেম্বরের ৮ থেকে ১৮ তারিখ ঢাকার দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডে বর্ষা–পরবর্তী লার্ভা জরিপ হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটির ৪০টি ও দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডে চলে জরিপের কাজ। ৩ হাজার ২৮৩টি বাড়ি থেকে সংগৃহীত নমুনায় উত্তর সিটির ১১ শতাংশের বেশি ও দক্ষিণের ১২ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

এডিস মশা

জরিপে যে লার্ভা পাওয়া গেছে তা গত বছরের প্রায় তিন গুণ। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার গত বছরের বর্ষা–পরবর্তী জরিপের তথ্য বলছে, সে বছর উত্তর সিটির প্রায় ৪ শতাংশ ও দক্ষিণের ৪ শতাংশের বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল।

এডিস মশা ও ভাইরাস পরিবেশে অনেক বেশি মাত্রায় রয়েছে। তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে আগাম বৃষ্টিপাত হলে আগামী মৌসুমে এডিস মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান

এ বছরের জরিপ কার্যক্রমের সঙ্গে ছিলেন কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এবার শীতের সময়ও ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব অনেক বেশি। অব্যাহত সংক্রমণ ও মৃত্যু সে চিত্রই তুলে ধরে। জরিপে গতবারের চেয়ে এবার অনেক বেশিসংখ্যক বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। গতবার জরিপের ফল দেখে দুই সিটিকে সাবধান করা হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি আরও নাজুক। তাই এখনই সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ না করলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’

লার্ভার ঘনত্বও তিন গুণের বেশি

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব যত বেশি থাকে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবার দুই সিটিতে বিআই গত বছরের চেয়ে তিন গুণের বেশি। গত বছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে বিআই ছিল যথাক্রমে প্রায় ৪ ও ৫ শতাংশের বেশি। চলতি বছর এ হার যথাক্রমে ১৩ ও ১৪ শতাংশের বেশি।

বাসাবাড়িতে লার্ভা পাওয়ার হার ও বিআইয়ের উচ্চহার শঙ্কা জাগানোর মতো বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ শতাংশের বেশি বাসাবাড়িতে লার্ভার উপস্থিতিই অনেক বেশি বলে গণ্য করা হয়। সেখানে এবার দ্বিগুণ বা তিন গুণ হয়েছে। আবার বিআইও বেশি। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে নাজুক হওয়ার আশঙ্কা আছে।’

এদিকে সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া যায়। গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে বর্ষাকালীন লার্ভা জরিপ হয় দুই সিটিতে। উত্তর সিটির ১ হাজার ৩৩৫টি বাড়ি ও দক্ষিণের ১ হাজার ৮১৫টি বাড়িতে এ জরিপ হয়। জরিপে উত্তরের ২৩ ভাগ ও দক্ষিণের ১৯ ভাগ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। অথচ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত জরিপে রাজধানীর ১২ শতাংশের বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এবার বর্ষা–পরবর্তী সময়েই গত বছরের বর্ষার মতো লার্ভা পাওয়া গেল। এটি আগামী বছরের জন্য বিপদের পূর্বাভাস বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী

সাধারণত তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এলে লার্ভা থেকে ডিম হতে পারে না। তবে চলতি ডিসেম্বরে রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলছিলেন, আবহাওয়ার এই ধারাবাহিকতায় এডিসের বিস্তার রোধ করা কঠিন হবে। রোগী বাড়তে থাকলে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। তাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। শীতে তাপমাত্রা কমে এডিস মশার বংশবিস্তারে ভাটা পড়ে। কিন্তু এবার তা হলো না। তাই সামনে পদক্ষেপ নিতে হবে অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে অনেক বেশি।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা আছে। মশা নিয়ন্ত্রণে তারা সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ায় উদ্যোগী হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকে।  

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সারা বছর ধরে নিয়মিত কর্মসূচি নিতে হবে সব দপ্তরকে। গতবারের বর্ষা–উত্তর জরিপে আমরা যে শঙ্কার কথা বলেছিলাম, এবারও সেই শঙ্কা ও তা মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়ে নতুন বছর পাড়ি দিতে হবে।