চার বছরে নকশা অনুমোদনের জন্য ৬ হাজার ২৮৪টি ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে। পরে সনদ পেয়েছে মাত্র ৪৮৪টি ভবন।
বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের আগে মালিকেরা যে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা করেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করেন না। ফলে তাঁরা আর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পান না। অনেকে ছাড়পত্রের জন্য যান-ই না।
ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে আগে নকশা অনুমোদন করাতে হয়। বাণিজ্যিক ভবনের নকশার জন্য দরকার হয় অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা ফায়ার সার্ভিসের কাছে জমা দিতে হয়। সেখান থেকে পরিকল্পনা অনুমোদন পেলেই কেবল রাজউকে নকশা অনুমোদনের আবেদন করা যায়।
যেমন রাজধানীর মহাখালীর ১৪ তলা খাজা টাওয়ার নির্মাণের আগে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সে অনুযায়ী অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেনি। ফায়ার সার্ভিস বলছে, খাজা টাওয়ারকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে, রাজধানীর ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০৬টি বিপণিবিতান। তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন।
খাজা টাওয়ারে গত বছরের অক্টোবরে আগুন লেগে তিনজনের মৃত্যু হয়। ভবনটিতে ইন্টারনেট সেবাদানকারীদের কার্যালয় ও সরঞ্জাম স্থাপন করা ছিল। আগুন লাগার কারণে সারা দেশে ইন্টারনেট–সেবায় বিঘ্ন ঘটেছিল।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে চার বছরে নকশা অনুমোদনের জন্য ৬ হাজার ২৮৪টি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তবে ভবন নির্মাণের পর অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত কার্যকারিতা সনদের জন্য আবেদন করেছে ১ হাজার ১৭৩টি ভবন কর্তৃপক্ষ। তবে সনদ পেয়েছে মাত্র ৪৮৪টি ভবন।
ভবন পরিদর্শনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মালিকপক্ষ নিয়ম মানছে না। অগ্নিনিরাপত্তা ও নির্বাপণ আইন (২০০৩) অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাসহ ভবন সিলগালা করে দেওয়ার ক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের ছিল। কিন্তু আইনের বিধিমালা স্থগিত হওয়ায় তা প্রয়োগের সুযোগ অনেক কম।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভবন নির্মাণ করা হলে ব্যবহারের জায়গা কিছুটা কমে যায়। সরঞ্জাম কিনতে হয়। আগুন লাগলে নেভানোর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী রাখতে হয়। বাড়তি ব্যয় করতে, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ভবনের জায়গা ছাড়তে অধিকাংশ ভবনমালিকই উৎসাহী নন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভবন পরিদর্শনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মালিকপক্ষ নিয়ম মানছে না। অগ্নিনিরাপত্তা ও নির্বাপণ আইন (২০০৩) অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাসহ ভবন সিলগালা করে দেওয়ার ক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের ছিল। কিন্তু আইনের বিধিমালা স্থগিত হওয়ায় তা প্রয়োগের সুযোগ অনেক কম।
কী দেখা হয়
ফায়ার সার্ভিস বলছে, তারা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার ছাড়পত্র দেওয়ার আগে ভবনের সামনে সড়ক কতটুকু প্রশস্ত, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান আছে কি না, আগুন নেভানোর গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না—এ বিষয়গুলো যাচাই করে।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আইনের প্রয়োগ নেই বলেই সেটি মানতে চান না ভবনমালিক। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন কর্তৃপক্ষ অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি আমলেই নেয়নি।
বেইলি রোডের ভবনটিতে গত বৃহস্পতিবারের আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করেছে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ।
খাজা টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। এর দুই বছর পর ভবনটির বিভিন্ন তলা ভাড়া দেওয়া শুরু হয়। অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত ছাড়পত্র নিয়ে খাজা টাওয়ার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে গত অক্টোবরে মহাখালীর খাজা টাওয়ারে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খাজা টাওয়ারে অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত ছাড়পত্র ছিল না। তবে তাঁরা একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলেই ফায়ার লাইসেন্স পায়নি।
জানা গেছে, খাজা টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। এর দুই বছর পর ভবনটির বিভিন্ন তলা ভাড়া দেওয়া শুরু হয়। অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত ছাড়পত্র নিয়ে খাজা টাওয়ার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালের ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে কর্মকর্তা-শ্রমিকসহ ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ওই ভবন নির্মাণে অনিরাপত্তার কোনো পরিকল্পনাই করা হয়নি।
‘এটা অবহেলা’
ঢাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা বাড়ছে। দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর পর জানা যাচ্ছে, ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ফায়ার সার্ভিস তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিল। বেইলি রোডের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে, রাজধানীর ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০৬টি বিপণিবিতান। তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন। উল্লেখ্য, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পরিদর্শন করা ভবনের মধ্য থেকে এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পাওয়া যায়। এটা ঢাকার সব ভবনের চিত্র নয়।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনে সুনির্দিষ্ট ধাপগুলোর একটি হলো অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহার সনদ) নেওয়া। অর্থাৎ অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করা হলো কি না, সেটি পরিদর্শন করে ব্যবহারের অনুমতি দেবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। ভবন নির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়মের অনেক ব্যত্যয় করা হয় বলে ভবনমালিক অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেন না। তিনি বলেন, ভবনমালিক আইন অমান্য করতে চাইতে পারেন। কিন্তু সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের আইনের প্রয়োগ করা উচিত। যদি আইন প্রয়োগ না করেন, এটা অবহেলা।