অগ্নিকাণ্ডের ১৩ বছর

নিমতলীবাসীর মনের ক্ষত এখনো শুকায়নি 

১২৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়নি। তবে জিডি হলেও এর কোনো তদন্ত হয়নি।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে
ফাইল ছবি

পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটারার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে তা মুহূর্তেই আশপাশের ভবনগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। ১৩ বছর আগের ভয়াবহ সেই আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনগুলোর ক্ষতচিহ্নগুলো এখন আর নেই, সেগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তবে স্বজনহারা ও দগ্ধ মানুষের শরীরের ক্ষত শুকালেও তাঁদের মনের ক্ষত এখনো শুকায়নি। সেই স্মৃতি তাঁদের আজও দগদগে।

নিমতলীর বাসিন্দারা বলেন, চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা ও ভবনমালিক গ্রেপ্তার হলেও নিমতলীর ভবনমালিকের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়নি। এখনো তাঁদের একটাই দাবি, শতাধিক মানুষের মৃত্যুর এ ঘটনায় যেন মামলা করে দায়ী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার করা হয়। নিমতলীর ঘটনায় মামলা ও বিচার হলে চুড়িহাট্টার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না বলে তাঁরা মনে করছেন।

আমার সাত বছরের ছেলে বৈশাখ (কাওছার হোসেন) চোখের সামনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। ছেলেসহ এতগুলো মানুষ মারা গেল। শরীরের ক্ষত শুকাইলেও মনের ক্ষত এখনো দগদগ করছে।
নিমতলীর ফলের দোকানি মামুন মিয়া
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ড হয়

১৩ বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটারার পাঁচতলা ভবনের বাসিন্দা গুলজার আলীর বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। ভয়াবহ আগুন মুহূর্তে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দগ্ধ হয়ে ১২৪ জন মানুষ মারা যান। অগ্নিদগ্ধ হন আরও কয়েক শ মানুষ। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি বলে শাস্তিও হয়নি কারও। তবে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল, সেটির তদন্ত হয়নি।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে বংশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তিনি জানেন না।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনের সূত্রপাত হওয়া বিধ্বস্ত পাঁচতলা সেই ভবন সংস্কার করা হয়েছে, আরও একতলা বাড়িয়ে সেটি ছয়তলা করা হয়েছে। বাড়ির মালিকেরা এখন সেই ভবনেই থাকেন বলে জানা যায়।

দেখা যায়, ওই ভবন ঘেঁষে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের উল্টো দিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা দোতলা বাড়িটিও সংস্কার করা হয়েছে। আগুনে ওই বাড়ির বাসিন্দা ফরিদউদ্দিনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। বেঁচে যাওয়া ফরিদউদ্দিনের তিন ছেলে পাশের এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। এলাকায় এমন আরও কিছু পোড়া বাড়ি ছিল, তা সংস্কার করা হয়েছে। কেউ কেউ নতুন করে ঘর ও দোকান বানিয়েছেন।

রাসায়নিকের গুদামের পাশে মুদিদোকানে পুড়ে মারা যান দোকানদার মো. শফিকের ভাই আবদুর রহিম ও পণ্য কিনতে আসা দুই নারী। পুড়ে ছাই হয়ে যায় দোকানটিও। ওই ভবনে থাকা রহিমের দুটি মেয়েও মারা গেছে সেদিন। শফিক প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর কেউ তাঁদের খোঁজও নেন না।

মা–বাবা ও স্বজনেরা সুস্থ ছিলেন। তাঁরা মারা গেছেন, এটা মেনে নেওয়াটা কষ্টদায়ক। আরও কস্টদায়ক এত বছরেও ওই ঘটনায় মামলা হলো না, বিচারও পেলাম না
রাসায়নিক গুদামের পাশে দোতলা বাড়ির মালিক মো. জুয়েল

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভয়াল অগ্নিকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ৩ জুন কুঁকড়ে ওঠেন নিমতলীবাসী, স্বজনদের মনে করে আহাজারিতে ভেঙে পড়েন তাঁরা। আপনজনদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দিনব্যাপী দোয়া মাহফিলেরও আয়োজন করেন। ওই দিন রাজনৈতিক সংগঠন ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেন।

সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা স্মরণ করে নিমতলীর ফলের দোকানি মামুন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সাত বছরের ছেলে বৈশাখ (কাওছার হোসেন) চোখের সামনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। ছেলেসহ এতগুলো মানুষ মারা গেল। শরীরের ক্ষত শুকাইলেও মনের ক্ষত এখনো দগদগ করছে।’

রাসায়নিক গুদামের পাশে দোতলা বাড়ির মালিক মো. জুয়েল একটি আবাসন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি সেদিনের ভয়াবহ আগুনে মা–বাবাসহ ১১ স্বজনকে হারিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, মা–বাবা ও স্বজনেরা সুস্থ ছিলেন। তাঁরা মারা গেছেন, এটা মেনে নেওয়াটা কষ্টদায়ক। আরও কস্টদায়ক এত বছরেও ওই ঘটনায় মামলা হলো না, বিচারও পেলাম না।’

নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছরের মাথায় (২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি) পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যান। নিমতলীর ঘটনার পরই পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর দাবি উঠেছিল। তখন রাসায়নিক পল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হতেই প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে যায়। এর মধ্যেই চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনে থাকা রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। চুড়িহাট্টার পর শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিকের কিছু গুদাম টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া ও ঢাকার শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে সরানোর উদ্যোগ নেয়। সেটিও এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজেদের উদ্যোগে অল্প কিছু গুদাম বুড়িগঙ্গার ওপারে সরিয়ে নেন বলে তাঁরা দাবি করেছেন।