ঢাকায় সবচেয়ে কম রোদ পায় মিরপুর-১৪ নম্বরসংলগ্ন কিছু এলাকার মানুষ। এর কারণ ঘন ও অপরিকল্পিত বসতি। মিরপুরের ওই সব গলিতে সকাল, দুপুর, বিকেল কোনো বেলাতেই রোদ ঢুকতে পারে না। এক-আধ দিন নয়, সারা বছরই অলিগলির এসব বাসাবাড়িতে সূর্যের আলো ঢোকে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
রোদ কম পেলে মানবদেহে ভিটামিন ডির ঘাটতি দেখা দেয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে, মেজাজ খিটখিটে হওয়াসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এ সমস্যা দূর করতে নগর-পরিকল্পনাবিদেরা ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে আনার, দুটি ভবনের মধ্যকার দূরত্ব যথাযথ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে অন্যান্য গবেষণার সঙ্গে এই গবেষণার ফলাফলও প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট অব স্কুল অব পাবলিক হেলথের স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহিদুল কাইয়ূম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি প্রকল্পের আওতায় আমরা নগর স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছি। নগরের মানুষের সূর্যের আলোর প্রাপ্যতা নিয়ে গবেষণাটি এর অন্যতম। সূর্যের আলো পাওয়া না-পাওয়ার সঙ্গে বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার সম্পর্ক আছে। গবেষণা থেকে আমরা জেনেছি, কিছু কিছু এলাকার মানুষ দিনের পর দিন সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই প্রতিবেদক মিরপুর-১৪ নম্বরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখেছেন। ক্যান্টনমেন্টের পাশে পুরাতন কচুখেত এলাকার একটি গলির দুই পাশে সারি সারি বহুতল ভবন। গলির শেষ মাথায়, পূর্ব দিকে আরও একটি বহুতল ভবন। ওই একটি ভবনের কারণে পুরো গলিতে সকালের রোদ ঢোকে না। শুধু সকাল নয়, দুপুর বা বিকেলেও এই গলির সিংহভাগ এলাকায় রোদ পড়ে না। সারা বছর একই পরিস্থিতি থাকে।
রোদ পড়ে কি পড়ে না, তা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা কম। ওই গলিতেই কথা হয় স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। সূর্যের আলো গলি পর্যন্ত পৌঁছায় কি না, ঘরের মধ্যে আলো যায় কি না, তা নিয়ে খুব চিন্তিত নন তিনি। তাঁর কথায়, ‘সূর্যের আলো নিয়ে এত তো কখনো ভাবিনি। শুধু জানি, আমার ফ্ল্যাটে সরাসরি সূর্যের আলো ঢোকে না, ঢোকার কোনো পথ নেই।’
মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশনের একটি গলিতেও দেখা গেল, দুই পাশের সারি সারি ভবনের নিচের দিকে রোদ পড়ার সুযোগ নেই। এ এলাকার বাসাবাড়িতে সকাল-বিকেল ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রোজকার কাজ করেন বাসিন্দারা।
গবেষকেরা মূলত কৃত্রিম উপগ্রহের জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমস বা জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব কটি ওয়ার্ডের জিআইএস তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। তারপর সারা বছর কোন এলাকায় কী পরিমাণ সূর্যের আলো ওই সব এলাকায় পৌঁছায়, তা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন।
তাতে দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যেসব এলাকায় বসতি অত্যন্ত ঘন, সেসব এলাকায় সূর্যের আলো কম পৌঁছায়। এলাকাভেদে সূর্যের আলো কমবেশি হওয়ার সঙ্গে কিছু বিষয়ের সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে আছে—ভবনের ছায়া, সরু রাস্তা বা গলি, একটি ভবনের সঙ্গে অন্য ভবনের দূরত্ব, ভবনের উচ্চতা।
গবেষকেরা দেখেছেন, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় কতগুলো ভবন ও ভবনের উচ্চতা কত, তার সঙ্গে সূর্যের আলোর প্রাপ্যতার সরাসরি সম্পর্ক আছে কি না। যদি একটি এলাকায় অনেক বেশি ভবন থাকে এবং ভবনগুলো বেশি উঁচু হয়, তাহলে ওই এলাকার মানুষ সূর্যের আলো কম পাবে।
গবেষকেরা বলছেন, প্রাকৃতিক আলো কম থাকার সঙ্গে স্বাস্থ্যের ওপর কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি থাকে। মানুষ দিনের বেলা যদি পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর সংস্পর্শে না আসে, তাহলে রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। পাশাপাশি ভিটামিন ডির ঘাটতি দেখা দেয়।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের প্রকল্প পরিচালক বিশ্বজিৎ ভৌমিক ভিটামিন ডির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের শরীর রোদের সংস্পর্শে এলে তা খাদ্যকে ভিটামিন ডিতে রূপান্তরে সহায়তা করে। যেসব দেশে সূর্যের আলো মানুষ কম পায়, সেসব দেশের মানুষের শরীরে ভিটামিন ডির স্বল্পতা দেখা যায়।
ঢাকা শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। অনেক বাড়ির শিশুরা রোদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায় না। বাড়িতে সূর্যের আলো নেই। শিশুরা গাড়ি করে স্কুলে যায়। স্কুলে খেলার মাঠ নেই, থাকলেও সে হয়তো খেলার সুযোগ পায় না। স্কুল থেকে আবার সে বাড়ি ফেরে। সারা দিনে সূর্যের মুখ তার দেখা হয় না। রোদহীন এক পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে।
যে কয়েকটি এলাকায় পরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে, তার মধ্যে মিরপুর অন্যতম। কিন্তু মিরপুরের কিছু এলাকাতেই গবেষকেরা সূর্যের আলো কম দেখেছেন। গবেষকেরা বলছেন, এ সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমত নীতিগতভাবে স্বীকার করতে হবে যে সূর্যের আলোর স্বল্পতা বা অনুপস্থিতি একটি সমস্যা। নগর-পরিকল্পনায়, ভবনের নকশা প্রণয়নে সূর্যের আলোর সর্বোচ্চ প্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সূর্যের আলো হচ্ছে মানুষের অধিকার। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ বাড়িতে সূর্যের আলো ঢোকে না। এটা আমাদের নগর-পরিকল্পনার বড় ধরনের ব্যর্থতা। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এটা আর চলতে দেওয়া যায় না। ভবনের উচ্চতা আমাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, দুটি ভবনের মধ্যকার দূরত্ব আইনানুগ হতে হবে। ভবন গড়লেই হবে না, তাকে বাসযোগ্য করতে হবে।’