হাতিরঝিলে হারিয়ে যাওয়া শিশুটি যেভাবে মায়ের কোলে ফিরল

মায়ের কোলে শিশু আবদুর রহিম। ঢাকা, ১৫ আগস্ট
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর হাতিরঝিলের মধুবাগসংলগ্ন পদচারী–সেতু পার হয়ে মহানগর প্রজেক্টের দিকে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ খোকন। সন্ধ্যা নামতে অল্প সময় বাকি। চলতে চলতে হঠাৎ টের পান তাঁর ডান হাতের একটি আঙুল ধরেছে কেউ। তাকিয়ে দেখেন আঙুল ধরে ছোট্ট এক শিশু তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স বড়জোর চার কি পাঁচ বছর হবে। শিশুটির গায়ে কিছু নেই। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখে শঙ্কার ছাপ।

খোকন হঠাৎ বুঝে উঠতে পারেন না ছেলেটি কে। তাই কোমল হাতটি ছাড়িয়ে এগোতে থাকেন। কিন্তু শিশুটি আবার তাঁর আঙুল ধরে। আতঙ্কে জড়সড় শিশুটি তখনো জানে না তার মা–বাবার কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না। দীর্ঘ সময় ধরে নিখোঁজ সে। মা–বাবা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন।

বাধ্য হয়ে খোকন আশপাশে খুঁজতে থাকেন শিশুটির পরিচিত কেউ আছে কি না। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। কোনো সাড়া না পেয়ে শিশুটিকে নিয়ে মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় প্রবেশ করেন। মহানগর প্রজেক্টের প্রবেশদ্বারে শিশুটিকে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। পাশের পান–সিগারেট বিক্রেতার সঙ্গে ছেলেটিকে নিয়ে কথা হয়। সবাই ছেলেটির কাছে জানতে চান তার নাম, পরিচয়, ঠিকানা।

সেসব প্রশ্ন শুনে শিশুটি সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ভয়ে জড়সড়। কখনো মায়ের জন্য কাঁদতে থাকে, আর বলতে থাকে, ‌মা যাব, বাবা যাব...। আর কিছুই বলতে পারছিল না। এর মধ্যে আরও প্রায় দুই ঘণ্টা কেটে যায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। হাতিরঝিলের আশপাশে শিশুটিকে নিয়ে ঘুরতে থাকেন খোকন। কিন্তু কেউ শিশুটিকে চেনে না। শিশুটি একসময় বলতে থাকে, ‌‌‌‘মা, বৃষ্টি, ঘুম...।’ তখন খোকন বুঝতে পারেন, শিশুটির মায়ের নাম বৃষ্টি। তার মা বাসায় ঘুমাচ্ছিল।

আবদুর রহিম ও তার মায়ের পাশে মোহাম্মদ খোকন। ঢাকা, ১৫ আগস্ট

একপর্যায়ে খোকনের সঙ্গে আরও তিন–চারজন জড়ো হয়ে যান। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক শিশুটির মা-বাবাকে খুঁজে তাকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া হবে। মাইকিং করার চিন্তা করেন। কিন্তু ওই সময় মসজিদের ফটক খোলা না থাকায় শিশুটিকে নিয়ে আবার আশপাশে বৃষ্টি নামের নারীকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু খোঁজ আর মিলছিল না। এভাবে রাত প্রায় নয়টার দিকে শিশুকে নিয়ে মাইকিং করার জন্য আবার মহানগর মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। শিশুটির মনে তখনো আতঙ্ক। এর মধ্যে দূর থেকে চার–পাঁচজন নারী দৌড়ে আসেন শিশুটির কাছে। প্রবীণ এক নারী শিশুটিকে খোকনের কাছ থেকে নিয়ে জড়িয়ে ধরেন। পাশ থেকে শিশুটির মা এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে কান্না করতে থাকেন।

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুটির নাম আবদুর রহিম। তার মা বৃষ্টি খাতুন জানান, তাঁদের বাসা তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া। বিকেল থেকে তাঁরা ছেলেকে খুঁজছিলেন। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘দুপুরের দিকে আমার ছেলে তার বাবার সঙ্গে বের হয়। পরে তার বাবা ছেলেটিকে ১০ টাকা দিয়ে বাসায় চলে যেতে বলেন। সব সময়ই সে বাসায় চলে আসে। কিন্তু ছেলেটি কীভাবে ফুটওভারব্রিজ পার হয়ে মহানগরের দিকে এল, সেটা বুঝতেছি না। এত দূরে আমার ছেলে কখনোই একা আসতে পারে না।’

দীর্ঘ সময় পরে ছেলেকে পেয়ে কাঁদতে থাকেন বৃষ্টি। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,‌‌ ‌‘আমি অনেক সময় ধরে ছেলেকে খুঁজছিলাম। মহানগরের দিকেও লোক পাঠিয়েছিলাম, পাই নাই। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো কেউ নিয়ে চলে গেছে...কোনো খারাপ কিছু হয়েছে। ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি, এটাই আমার শান্তি।’

মোহাম্মদ খোকন পেশায় গাড়িচালক। ভাড়ায় গাড়ি চালান। তিনি মহানগরের দিকে ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে দুইবার ছেলেটি আমার আঙুল ধরছে, এটা দেখে মায়া হলো। সে কোনো কথা বলতে পারছিল না। আমি অনেক সময় ধরে পুরো এলাকায় ছেলেটিকে নিয়ে তার মা–বাবাকে খুঁজেছি। শত শত মানুষকে জিজ্ঞেস করছি তাকে চেনে কি না। কিন্তু কেউই ছেলেটিকে চেনে না।’

ছোট একটা ছেলে তাকে রেখে গেলে পরে কী হয়, বলা তো যায় না, সেই চিন্তা থেকে শিশুটিকে মা–বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান তিনি।