রাজধানীর মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’-এর জন্য কেনা প্রায় দেড় কোটি টাকার পাস্তুরাইজিং মেশিন, অত্যাধুনিক ফ্রিজসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে ধুলা জমেছে।
তিনজন মুসলিম দাতার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দেওয়া টাকায় কেনা মেশিনগুলো তালাবদ্ধ ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। মিল্ক ব্যাংকের কারণে ভবিষ্যতে দুধমায়ের সন্তানদের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে, তার সমাধান সম্ভব কি না, এ নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতামত পাওয়া না গেলে এ মিল্ক ব্যাংক চালু করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন দুধমা-সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় এখনো কোনো মতামত দিতে পারছে না। মায়ের বুকের দুধ সংগ্রহ এবং অন্য নবজাতকদের খাওয়ানোর ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়াহর কোনো লঙ্ঘন না করে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে এ ধরনের ব্যাংক করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক অনুমতি না দিলেও মনোভাব ‘ইতিবাচক’ বলে বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগটি ঢাকা জেলার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) নবজাতক পরিচর্যাকেন্দ্র (স্ক্যানো) এবং নবজাতক আইসিইউর (এনআইসিইউ) নিজস্ব উদ্যোগ। বেসরকারি আর্থিক সহায়তায় ব্যাংকটি স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটি যাত্রা শুরুর আগে ব্যাংকের জনবলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। যন্ত্রপাতি সব চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে এখন আপাতত সবকিছুই থেমে আছে।
এই উদ্যোগের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি চেয়ে গত বছরের আগস্টে রাজধানীর চারটি হাসপাতালে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক করার জন্য আবেদন করেছিল বেসরকারি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল (এফএইচআই ৩৬০)। অনুমতি পেতে পেতে সংশ্লিষ্ট যে প্রকল্প তার মেয়াদই শেষ হয়ে গেছে। ফলে সে উদ্যোগও আর আলোর মুখ দেখেনি। দেশে মিল্ক ব্যাংক হলে ‘আইনগত ও ধর্মীয় সমস্যা’ তৈরি হবে দাবি করে উকিল নোটিশও পাঠানো হয়েছিল।
আইসিএমএইচের আশপাশের কয়েকটি মাদ্রাসার কয়েক ব্যাংকের মাধ্যমে মায়ের বুকের দুধ বিক্রি করা হবে, একই পাত্রে একাধিক মায়ের বুকের দুধ মেশানো হবে। এতে দুধমা চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যাবে, এ ধরনের বিষয়গুলোকে সামনে আনেন। তারপর ব্যাংক বন্ধের আন্দোলন শুরু করে কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি। আইসিএমএইচ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আনুষ্ঠানিক মতামতের ভিত্তিতে তা পুনরায় চালু করার জন্য মতামত জানতে চেয়ে চিঠি পাঠায়। তবে করোনার ব্যাপক বিস্তারে বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ পড়ে। করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেও বিষয়টি আর সেভাবে আলোচনায় আসেনি।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনে মহাপরিচালক হিসেবে ড. মো. মুশফিকুর রহমান ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যোগ দিয়েছেন। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এ পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ-সংক্রান্ত কোনো আলোচনা শোনেননি। বিষয়টি যেহেতু সংবেদনশীল, তাই যথাযথ আলোচনার মাধ্যমেই তার সমাধান করতে হবে।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইরান, ইরাক, পাকিস্তান ও কুয়েতে মায়ের দুধ সংরক্ষণে ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। মালয়েশিয়া বিষয়টি পরিকল্পনার মধ্যে রেখেছে। সিঙ্গাপুরে বিশেষ নিয়মকানুন মেনে মুসলিমদের জন্য ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। আইসিএমএইচের নির্বাহী পরিচালক এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিল্ক ব্যাংক নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। তবে ব্যাংক নিয়ে যাঁরা কাজ করবেন এবং যাঁরা সেবা পাবেন, তাঁরা আসলে সেভাবে এখনো প্রস্তুত নন। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে কিছু না হয়, কোনো বিতর্ক যাতে না থাকে, এ কারণে জনমত গঠন করা প্রয়োজন। এসব জটিলতায় মিল্ক ব্যাংকের মেশিনগুলো সচল করতে পারছি না।’
২০১৯ সালে মিল্ক ব্যাংক উদ্বোধনের সময় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছিলেন, যে মায়েদের সন্তান জন্মের পর মারা গেছে বা নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর পরও মায়ের বুকে অতিরিক্ত দুধ আছে, সেই মায়েরা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুধ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন। যে নবজাতকের জন্মের পরই মা মারা গেছেন বা যাদের মা অসুস্থতার জন্য দুধ খাওয়াতে পারছেন না, সেই নবজাতকেরা এই দুধ খেতে পারবে।
আইসিএমএইচ ক্যাঙারু মাদার কেয়ারে মা ছাড়া খালা, নানি বা অন্যদের সঙ্গে যে নবজাতকদের রাখা হচ্ছে, তারাও এ দুধ খেতে পারবে। স্ক্যানো ও এনআইসিইউতে থাকা অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া ও অসুস্থ নবজাতকদের সংরক্ষণ করে রাখা দুধ খাওয়ানো হবে। এ ছাড়া দত্তক নেওয়া সন্তানের অভিভাবকেরা এখান থেকে দুধ নিয়ে খাওয়াতে পারবেন। বিভিন্ন সময় স্বজনেরা নবজাতককে ফেলে দেন। এই স্বজন-পরিত্যক্ত নবজাতকদের বাঁচাতেও মিল্ক ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। মায়েদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ ও বিতরণে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা নেওয়া হবে না।
আইসিএমএইচের সহযোগী অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউটের এনআইসিইউ ও স্ক্যানোর ইনচার্জ মজিবুর রহমান হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই ব্যাংক চালু করার আগে তিনি নিজে স্পেন ও ভারতের দুটি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি জানালেন, যেসব দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক তৈরি করা হয়েছে, সেসব দেশে নবজাতকের মৃত্যু রোধ এবং শিশুর অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বাজারজাত করা মায়ের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্যের ব্যবহার কমেছে।
মজিবুর রহমান বলেন, ইসলামে দুধমায়ের ছেলেমেয়ের সঙ্গে ওই মায়ের দুধ যে ছেলে বা মেয়ে খেয়েছে, তাদের বিয়ে নিষিদ্ধ।
বিষয়টি মাথায় রেখেই সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে মা দুধ খাওয়াবেন এবং যে শিশু খাবে, তার তথ্য সংরক্ষণ করার সার্বিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে বিতর্ক দেখা দেওয়ায় আবার নতুন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। ইনস্টিটিউটে মিল্ক ব্যাংকটির অবস্থান হলেও তথ্য সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সার্বিক নজরদারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন যাতে করতে পারে, তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এবং মেটারনাল, নিওনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথের লাইন ডিরেক্টর চিকিৎসক মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং সংশ্লিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতামত নেওয়াটাও জরুরি। করোনায় সে উদ্যোগ অগ্রসর হতে পারেনি। আবার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মো. শামসুল হক আরও বলেন, কোনো নবজাতক মায়ের বুকের দুধ না পেলে বর্তমানে পারিবারিক উদ্যোগে আশপাশের মায়েদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে খাওয়ানো হচ্ছে। কোন মায়ের দুধ খেল, তা সবার জানা থাকছে। মিল্ক ব্যাংকে এই তথ্যগুলো কতটুকু সংরক্ষণ করা যাবে, সে চ্যালেঞ্জ তো আছেই।
তবে ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকে সার্বিক নজরদারি বাড়ানো হলে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তথ্য সংরক্ষণ করা হলে দুধমা নিয়ে যে আশঙ্কা, তা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হবে।
গত বছর এফএইচআই ৩৬০ ‘স্ট্রেনদেনিং মাল্টিসেক্টরাল নিউট্রিশন প্রজেক্ট’-এর আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক ইউনিট, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং আইসিএমএইচে মিল্ক ব্যাংক করতে চেয়েছিল।
এফএইচআই ৩৬০-এর প্রকল্পটির সাবেক উপদেষ্টা চিকিৎসক গাজী মাসুম আহমদ বলেন, মিল্ক ব্যাংকের তথ্য ৩০ বছর বা এরও পর যাতে পাওয়া যায়, তার উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য সময়ও দিয়েছিলেন, বিভিন্ন কারণে পরে আর তা সম্ভব হয়নি। চারটির মধ্যে দুটি হাসপাতাল এ নিয়ে কথা বলতেই রাজি হয়নি। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে কাজটি শুরুই করা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নবজাতক এবং শিশুদের জীবন বাঁচানোর জন্যই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক। তাই সরকার বিষয়টি নিয়ে যে বিতর্ক তার সমাধান করে এ ধরনের ব্যাংক তৈরিতে উদ্যোগ নিতে পারে।