ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে ‘ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের বিজয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। এ ঘটনাকে ফরাসি বিপ্লবের চেয়েও হাজার গুণ কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ধর্মবাদ ও সেক্যুলারবাদের বিভাজন তরুণেরা ভেঙে দিয়েছেন। এটাই এই বিপ্লবের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়কে কী করে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেটাই এখনকার প্রধান রাজনৈতিক কাজ।
আজ সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে এক বক্তৃতায় ফরহাদ মজহার এ কথাগুলো বলেন। ‘গণ–অভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং গঠনতন্ত্র’ শিরোনামে এই বক্তৃতার আয়োজন করেছিল ভাববৈঠকি।
বক্তৃতায় ফরহাদ মজহার বলেন, ধর্মবাদ ও সেক্যুলারবাদের বিভাজন তরুণেরা ভেঙে দিয়েছেন। এটাই এই বিপ্লবের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। তিনি বলেন, ‘পুরো গণ–অভ্যুত্থানটা সফল হয়েছে। কারণ, আমরা আমাদের তথাকথিত পরিচয়কে প্রধান করিনি। আমরা প্রধান করেছি ফ্যাসিস্টদের তাড়ানোর লক্ষ্যকে। যে ঘটনা ঘটেছে, তা ফরাসি বিপ্লবের চেয়েও এক হাজার গুণ কঠিন। এই বিজয় হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থানের বিজয়।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘অলিখিত যে অভিপ্রায়টা গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, সেই অভিপ্রায়টাকে এখন লিখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে আমরা সাময়িককালের একটা গঠনতন্ত্র চালু রাখতে চাইলে তিনি (ড. ইউনূস) সোজা একটা বক্তব্য দিলেই হবে। সেটা হলো, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, এমন আইন বাদে সব আইন বাতিল। জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়কে কী করে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেটাই আমাদের এখনকার প্রধান রাজনৈতিক কাজ।’
গণ–অভ্যুত্থানের সমর্থক জনগণকে এর সঙ্গে যুক্ত করে গণ–অভ্যুত্থানকে একটা গণবিপ্লবী রূপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘সবাই মিলে বাংলাদেশকে আমরা নতুনভাবে গঠন করতে চাই। এই আলোচনার মতো হাজার হাজার গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিল করতে হবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা-উপজেলায়। এর মধ্য দিয়ে জনগণ বলবে, তারা কী চায়, তাদের অভিপ্রায় কী। এখান থেকে যে চিন্তাটা বেরোবে, যে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেটাই হবে আগামী দিনে গঠনতন্ত্রের ভিত্তি।’
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, অবিলম্বে সারা দেশে গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিল ঘোষণা করতে হবে। অবিলম্বে মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরাতে হবে। কারণ, তিনি শেখ হাসিনার নিয়োজিত। কিছুতেই ফ্যাসিস্টদের রাখা যাবে না। তিনি বলেন, ‘প্রতিবিপ্লব ঘটে গেছে এ কারণে যে পুরো বিপ্লবটাকে আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে বঙ্গভবন বা গণভবনে ঢুকতে দিয়েছি। এটা এই গণ–অভ্যুত্থানের খুব বড় ট্র্যাজেডি। এটা হওয়া উচিত ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিংবা রাজু ভাস্কর্যের সামনে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসে বলবেন, আমি জনগণের অভিপ্রায় দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছি। ফলে পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা আর নেই। প্রতিবিপ্লবটাকে শোধরানোর একটা পথ হলো গণসার্বভৌমত্বের ধারণা।’
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠনের ওপর জোর দেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণ এখনো বিভিন্নভাবে বিভক্ত। এই বিভাজন ভাঙা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে আমরা বলি গঠন। জাতিবাদের ফাঁদে পা না দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত সত্যিকারের পলিটিকো-লিগ্যাল একটা ধারণা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। এটাকে বলা হয় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী। বৈচিত্র্য নিয়েই আমরা সবাই এর অন্তর্গত। এটাই আমাদের শক্তি। গঠন মানে এই বিভাজনকে কমিয়ে ফেলা।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর (মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মাজার ইত্যাদি) মধ্যে বিরোধ লাগানো যাবে না। তারা আলোচনা করুক, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বটা দৃঢ় হোক। এর মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীটা শক্তিশালী হবে। এর পাশাপাশি আমাদের একটা কালেকটিভ (সমষ্টিগত) পরিচয় এবং কমন (সর্বজনীন) উদ্দেশ্য লাগবে। একই সঙ্গে পরস্পরের প্রতি আমাদের দায় স্বীকার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠনে ইতিহাস, সংস্কৃতি, কল্পনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠনের উপাদানগুলো আমরা যত দ্রুত আত্মস্থ করতে পারব, তত দ্রুত আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অনেকেই এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বক্তৃতা শেষে তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ফরহাদ মজহার।