খেয়ালখুশিমতো পদ বানিয়ে ঢাকা ওয়াসায় নিয়োগ

নিয়োগ দিতে হলে নির্দিষ্ট পদ থাকতে হয়। জনবলকাঠামোতে না থাকলেও নতুন পদে নিয়োগ দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা ওয়াসা

জনবলকাঠামোতে না থাকলেও পরিচালক পদে দুজনকে নিয়োগ দিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় দুই কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এই অভিযোগে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

শুধু এই দুই পরিচালক নন, জনবলকাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম) নেই এমন অন্তত ৯টি পদে লোকবল নিয়োগ দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে, এমন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার বিধান রয়েছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিধান মানা হয়নি। ফলে দুই পরিচালক নিয়োগের মতোই এসব লোকবলকে বেতন-ভাতা দিয়ে সরকারি অর্থের অপচয় করা হচ্ছে।

ওয়াসার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধান শৃঙ্খলা কর্মকর্তা ও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার মাসিক বেতন ১ লাখ টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্স কর্মকর্তার বেতন ৬০ হাজার ও সহকারী ভ্যাট-ট্যাক্স কর্মকর্তার বেতন ৫০ হাজার টাকা। সহকারী আইন কর্মকর্তার বেতন ৫০ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদিত পদের বাইরে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হলেও নির্দিষ্ট পদ থাকতে হবে। পদের বাইরে এমন নিয়োগ সরাসরি দুর্নীতি। অর্গানোগ্রামে না থাকলে আগে পদ সৃষ্টি করতে হয়। এতে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে।

অনুমোদিত পদের বাইরে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। পদের বাইরে এমন নিয়োগ সরাসরি দুর্নীতি।
মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, চাকরির বিধিবিধানবিশেষজ্ঞ

ঢাকা ওয়াসায় লোকবল নিয়োগের বিষয়ে সরকার অনুমোদিত প্রবিধানমালা রয়েছে। ‘ঢাকা ওয়াসা (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকরি প্রবিধানমালা, ২০১০’ অনুযায়ী কোন পদে কীভাবে লোকবল নিয়োগ দেওয়া যাবে, যোগ্যতা কী হবে, সেগুলোর বিস্তারিত বলা রয়েছে। আইন অনুযায়ী, এসব পদের বাইরে ঢাকা ওয়াসায় লোকবল নিয়োগের সুযোগ নেই।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান এবং ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্গানোগ্রামে না থাকলেও প্রধান শৃঙ্খলা কর্মকর্তা, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, ফিন্যান্স ও ভ্যাট-ট্যাক্স কর্মকর্তা, সহকারী ফিন্যান্স ও ভ্যাট-ট্যাক্স কর্মকর্তা, সহকারী আইন কর্মকর্তা, ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া (ডিএমএ) ম্যানেজার, ডিএমএ সহকারী ম্যানেজার, বিলিং সহকারী ও মেশিনম্যান পদে লোকবল নিয়োগ দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ডিএমএ ম্যানেজার আছেন ৮ জন ও ডিএমএ সহকারী ম্যানেজার আছেন ২৪ জন। বিলিং সহকারী ও মেশিনম্যান পদে শতাধিক ব্যক্তি নিয়োগ পেয়েছেন।

অর্গানোগ্রামে না থাকলেও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ চিফ মিডিয়া অফিসার ও মিডিয়া অফিসার পদে লোকবল নিয়োগ দেওয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ‘স্ক্যাডা অপারেশন ইঞ্জিনিয়ার’ নামে অর্গানোগ্রাম–বহির্ভূত একটি পদে ৪৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কার্যক্রমও চলমান।

পদ সৃজন করার পরেই নতুন পদে লোক নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করতে পারে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু উপরে উল্লিখিত পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এই পদগুলোর ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে বোর্ডের অনুমতি নেওয়া হয়েছে, কিন্তু অর্গানোগ্রামে এসব পদ সৃজন করা হয়নি।

এসব লোকবল নিয়োগের বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি। পরে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেককে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। তিনি জবাব পাঠাননি।

দুই পরিচালক নিয়ে মামলার সুপারিশ

ঢাকা ওয়াসায় দুই পরিচালক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে দুই সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান দল। চলতি বছরের মে মাসে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

দুদক ও ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্গানোগ্রামে পরিচালক (উন্নয়ন) ও পরিচালক (কারিগর) হিসেবে কোনো পদ না থাকলেও পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বৈধ কোনো পদ সৃষ্টি না করে এবং নিয়োগসংক্রান্ত নীতিমালা ও প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ না করে অবৈধ নিয়োগ দিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ দুই পরিচালককে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানসহ বোর্ডের ১০ সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই নিয়োগ দেন। দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ ও দণ্ডবিধির ধারা উল্লেখ করে এমডিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

বেতন-ভাতায় খরচ কত

জনবলকাঠামোতে না থাকা যেসব পদে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেতন-ভাতা চুক্তিতে উল্লেখ থাকে। ওয়াসার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধান শৃঙ্খলা কর্মকর্তা ও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার মাসিক বেতন ১ লাখ টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্স কর্মকর্তার বেতন ৬০ হাজার ও সহকারী ভ্যাট-ট্যাক্স কর্মকর্তার বেতন ৫০ হাজার টাকা। সহকারী আইন কর্মকর্তার বেতন ৫০ হাজার টাকা। এই পাঁচ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাতেই বছরে সংস্থাটির খরচ হচ্ছে প্রায় ৮৭ লাখ টাকা। বাকি পদগুলোর বেতন-ভাতা যোগ হলে যা বছরে কয়েক কোটিতে দাঁড়াবে।