বিবি মরিয়ম শাহি মসজিদ। নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত এই মসজদটি ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ঢাকা, ১ এপ্রিল
বিবি মরিয়ম শাহি মসজিদ। নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত এই মসজদটি ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ঢাকা, ১ এপ্রিল

বিবি মরিয়ম শাহি মসজিদ

দালান ও মার্কেটের আড়ালে চমৎকার প্রাচীন স্থাপত্য

রাজধানীর নীলক্ষেতের বাবুপুরা মার্কেটের ভেতরে শাহ সাহেব বাড়ি রোডে বিবি মরিয়ম শাহি মসজিদ। মোগল রীতির স্থাপনাটি এখন চারপাশের দালান ও মার্কেটের দোকানের আড়ালে পড়ে গেছে।

কামিনী ফুলের গাছটি তার লম্বা শাখা বাড়িয়ে দিয়েছে ‘বিবি মরিয়ম’–এর কবরের ওপর। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় তার অন্তিম শয্যা। পাকা কবরটি অবশ্য সরাসরি দেখা যায় না। চারপাশে ইটের প্রাচীর ও তার ওপর লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। গ্রিলের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের আয়াতে কালিমা লেখা গিলাফ দিয়ে ঘেরা। এর ওপরে ঝুঁকে আছে কামিনীর শাখা। এই কবরের পাশ দিয়েই ৩০০ বছরের বেশি প্রাচীন ‘বিবি মরিয়ম শাহি মসজিদে’ প্রবেশের পথ।

মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, সৈয়দা বিবি মরিয়ম সালেহা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিজরি ১১১৮ সন মোতাবেক ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে। তবে তাঁর মৃত্যুর তারিখ জানা যায় না। মসজিদের দক্ষিণ পাশেই একটি কবরস্থান। তার ফটকে লেখা—‘হযরত শায়খ গোলাম মোহাম্মদ মোজাদ্দেদী ওরফে বাঘু দেওয়ান (রহ.)-এর মাজার শরিফ’। বাঘু দেওয়ানের ওফাতের তারিখ লেখা ২৬ রজব, ৯৮৯ হিজরি। বিবি মরিয়ম ছিলেন বাঘু দেওয়ান পীর সাহেবের নাতনি। তাঁর বাবা শাহ আবদুল্লাহর কবরও রয়েছে মসজিদের পাশের এই কবরস্থানে পীর সাহেবের কবরের পাশে।

বিবি মরিয়ম মসজিদটি নীলক্ষেতের বাবুপুরা মার্কেটের ভেতরে। ৪৩ বাবুপুরা, শাহ শাহেব বাড়ি রোডে। ঢাকা নিউমার্কেটের পূর্ব দিকে বলাকা সিনেমা হলের দক্ষিণ পাশের সড়ক দিয়েও এই মসজিদে যাওয়া যায়। আগে বলাকা সিনেমার সামনে থেকেই তিন গম্বুজবিশিষ্ট বিবি মরিয়মের মসজিদটি দেখা যেত। মোগল রীতির স্থাপনাটি এখন চারপাশের দালান ও মার্কেটের দোকানের আড়ালে পড়ে গেছে। আগে থেকে জানা বা দেখা না থাকলে নীলক্ষেতের বাবুপুরা মার্কেটের ভেতর যে এমন চমৎকার একটি প্রাচীন স্থাপত্য ও নানা ধরনের গাছাপালার ছায়াঘেরা বেশ বড় একটি কবরস্থান আছে, তা অনেকে ভাবতেই পারবেন না।

মসজিদের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৮১ মিটার ও প্রস্থ ৩ দশমিক ৯৮মিটার। এই মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে প্রধান মিহরাব ও পাশে দুটি ছোট মিহরাব। উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দরজা এই দরজাগুলোর পাশে দুটি করে কুলঙ্গি। পূর্ব দিকে দেয়ালে তিনটি প্রবেশপথ।

গত রোববার দুপুরে মসজিদে গিয়ে দেখা গেল, প্রাচীন স্থাপনাটি খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে। পুরোনো বারান্দার সামনের জায়গায় বিবি মরিয়মের কবর পর্যন্ত বারান্দা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই সম্প্রসারিত অংশের ওপরে টিনের ছাউনি দিয়েও নামাজের ব্যবস্থা করা। ফলে মসজিদটি এখনো একতলা পর্যন্তই আছে।

পুরোনো মসজিদটি খুব বড় নয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে বিবি মরিয়ম মসজিদের পরিমাপ উল্লেখ করেছেন—দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৮১ মিটার ও প্রস্থ ৩ দশমিক ৯৮মিটার। এই মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে প্রধান মিহরাব ও পাশে দুটি ছোট মিহরাব। উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দরজা এই দরজাগুলোর পাশে দুটি করে কুলঙ্গি। পূর্ব দিকে দেয়ালে তিনটি প্রবেশপথ। মাঝেরটি বড়। এই দরজা ও মিহরাবগুলো ঐতিহ্যবাহী অর্ধগম্বুজ আকৃতির খিলানযুক্ত। দেয়াল চুন-সুরকির আস্তর করা। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। গম্বুজগুলোর গোড়ায় নকশা করা। এ ছাড়া চারকোনা দেয়ালে চতুষ্কোণ আকৃতির মিনার। এই মিনারগুলোর চূড়ায় রয়েছে ছোট আকারের গম্বুজ।

নকশা অনুমোদনসহ যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ঈদুল ফিতরের পরেই নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। পুরোনো মসজিদ ও বিবি মরিয়মের সমাধি অক্ষত থাকবে।
সৈয়দ মোহাম্মদ সুজন, বিবি মরিয়ম মসজিদের কোষাধ্যক্ষ

বিবি মরিয়ম মসজিদ ওয়াক্ফ সম্পত্তি। তাঁর বাবা শাহ আবদুল্লাহ গংয়ের ওয়াক্ফ স্টেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয় বলে জানালেন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ মোহাম্মদ সুজন ও বাঘু দেওয়ান মাজারের বর্তমান গদিনশিন পীর শাহেদুর রহমান। পবিত্র জোহরের নামাজের পর মসজিদেই কথা হলো তাঁদের সঙ্গে।

বিবি মরিয়ম মসজিদের ভেতরে বাইরে ছাদে এক হাজারের মতো মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। কিন্তু এই এলাকায় এখন লোকসংখ্যা অনেক, মার্কেটেই প্রচুর দোকান। সেগুলোর মালিক–কর্মচারী কয়েক হাজার। মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন ভবন হবে ছয়তলা। গত বছর ২৫ অক্টোবর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এতে লেখা রয়েছে—‘মসজিদের মূল অংশ অক্ষুণ্ন রেখে পুনর্নির্মাণ করার লক্ষ্যে মেয়র এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন’। সৈয়দ মোহাম্মদ সুজন জানালেন, নকশা অনুমোদনসহ যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ঈদুল ফিতরের পরেই নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। পুরোনো মসজিদ ও বিবি মরিয়মের সমাধি অক্ষত থাকবে। মসজিদটি হবে এই দুটি স্থাপনার মাঝখানের জায়গায়। সবার আর্থিক অনুদানেই ভবনটি নির্মিত হবে বলে তাঁরা আশাবাদী।