৫৬৭ বছর ধরে মিনার থেকে আসে আজানের ধ্বনি

পুরান ঢাকার নারিন্দায় মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪৫৬ সালে। ‘বিনত বিবির মসজিদ’ নামের এই মসজিদ এখন পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে, ওয়ারী থানায়

৫৬৭ বছর আগে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার নারিন্দায়

প্রায় ২৪ তলা বাড়ির সমান ২৪৩ ফুট উঁচু মিনার থেকে ভেসে আসে এশার আজানের সুর। আশপাশে মাথা তোলা বহুতল ভবনগুলো ছাপিয়ে উঠেছে ৫৬৭ বছর পুরোনো মসজিদের এই নতুন মিনার। আলোকোজ্জ্বল মিনারটি বেশ খানিকটা দূর থেকেই দেখা যায়। বৃহস্পতিবার এশার নামাজের পরে শুরু হয় এবারের পবিত্র রমজান মাসের খতম তারাবির প্রথম দিনের জামাত।

চৈত্রের রৌদ্রতপ্ত দিনের শেষে রাতের প্রথম প্রহরের মৃদুমন্দ বাসন্তী হাওয়ায় ভেসে আসা এশার আজান কানে পড়তেই মুসল্লিরা একে একে এসে কাতারবদ্ধ হচ্ছিলেন রাজধানী ঢাকার এই সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদে। পুরান ঢাকার নারিন্দায় মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৮১৬ হিজরিতে, খ্রিষ্টীয় ১৪৫৬ সালে। ‘বিনত বিবির মসজিদ’ নামের এই মসজিদ এখন পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে, ওয়ারী থানায়। চেনার জন্য সহজ পথটি হলো বিখ্যাত বলধা গার্ডেনের পাশ দিয়ে, খ্রিষ্টান কবরস্থানকে হাতের বাঁয়ে রেখে সোজা নাক বরাবর চলতে থাকলে পড়বে নারিন্দা চৌরাস্তা। সেটি পেরিয়ে খানিক সামনে গেলেই ‘বিনত বিবির মসজিদ’। তবে এর নতুন সুউচ্চ মিনারটি দেখা যায় অনেক দূর থেকেই।

মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা গেছে, কোনো এক মরহমতের কন্যা মোসাম্মত বখত বিনত (পুরো নাম মোসাম্মত বখত বিনত দোখতর-ই-মরহমত) এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। তখন বাংলায় ছিল সুলতানি আমল

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেল, পুরোনো মসজিদের চারপাশে অনেক বহুতল ভবন উঠেছে। একেবারে সামনে না এলে পুরোনো মসজিদটি দেখা যায় না। তবে এটি টিকে থাকলেও হুবহু আগের অবস্থায় নেই। একতলা মসজিদটির ওপরে একই আকৃতির দুটি গম্বুজ। চারকোনায় চারটি সরু মিনার। গম্বুজ, মিনার এবং সামনে অর্থাৎ পূর্বে এবং উত্তরের দেয়াল রঙিন টাইলসের টুকরা বসানো হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক আ ক ম যাকারিয়া তাঁর ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ে এ মসজিদ সম্পর্কে বলেছেন, বিনত বিবির আদি মসজিদটি ছিল এক গম্বুজবিশিষ্ট। পরে এটি সংস্কার ও পরিবর্ধন করার সময় আরেকটি গম্বুজ তৈরি করা হয়। আদি মসজিদটি ছিল বর্গাকার। ভেতরের আয়তন ছিল ৩.৬৩ বর্গমিটার। প্রতিটি দেয়াল ৩.৬৩ মিটার প্রশস্ত। এই মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা গেছে, কোনো এক মরহমতের কন্যা মোসাম্মত বখত বিনত (পুরো নাম মোসাম্মত বখত বিনত দোখতর-ই-মরহমত) এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। তখন বাংলায় ছিল সুলতানি আমল। সালতানাত পরিচালনা করছিলেন সুলতান নাসির-উদ্-দীন মাহমুদ শাহ্।

সুলতানি আমলে প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি সম্প্রসারিত ভবনটি সাত তলা হবে

ইতিহাসবিদেরা একমত যে এটিই রাজধানীর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ এবং প্রাক্‌–মোগল যুগের অন্যতম প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন। আ ক ম যাকারিয়া বলেছেন, ‘লিপি প্রমাণে এটিই ঢাকার প্রাচীনতম মসজিদ।’ সেই অর্থে ঢাকার প্রথম মসজিদ বলা হয় একে।

পুরোনো মসজিদের সামনের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ছয়তলা নতুন ভবন। এটি পূর্ব-পশ্চিম লম্বা। মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা কাওসার আহমেদ জানালেন, প্রতিটি তলায় ১৭টি করে কাতার হয়। পুরোনো মসজিদেও নামাজ হচ্ছে। সেখানে পাঁচটি কাতার হয়। সব মিলিয়ে এখানে এখন প্রায় তিন হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

‘বিনত বিবির মসজিদ’ চেনার জন্য সহজ পথটি হলো বিখ্যাত বলধা গার্ডেনের পাশ দিয়ে, খ্রিষ্টান কবরস্থানকে হাতের বাঁয়ে রেখে সোজা নাক বরাবর চলতে থাকলে পড়বে নারিন্দা চৌরাস্তা। সেটি পেরিয়ে খানিক সামনে গেলেই দেখা যাবে মসজিদটি

মাওলানা কাওসার আহমেদ ২০১৫ সাল থেকে বিনত বিবি মসজিদে ইমাম হিসেবে খেদমত করছেন। নিয়মিত ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি খতম তারাবিতেও ইমামতি করে থাকেন। এবারও করছেন (খতিব হিসেবে রয়েছেন মুফতি শহীদুর রহমান। তিনি শুধু জুমার নামাজে ইমামতি করেন)। তারাবির জন্য তাঁর সঙ্গে সহকারী হিসেবে আছেন তরুণ হাফেজ মোহাম্মদ গেলমান রহমান। তিনি মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য মজিবর রহমানের ছেলে।

মসজিদের নতুন ভবন তৈরির সম্পূর্ণ ব্যয় মিটিয়েছেন স্থানীয় মুসল্লিরা দানের হাত প্রসারিত করে। কথা হলো পরিচালনা কমিটির সদস্য মজিবর রহমান, প্রবীণ মুসল্লি মো. ইয়াকুব আলী, আবদুল সালাম, মো. আবু তাহেরসহ কয়েকজনের সঙ্গে। বংশপরম্পরায় এই মুসল্লিরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করে থাকেন। এঁদের মধ্যে আবু তাহেরের বাড়িটি মসজিদের প্রাচীরসংলগ্ন। মসজিদের হোল্ডিং নম্বর নারিন্দা-৬, তাঁর বাড়ির নম্বর ৭। মুসল্লিরা জানালেন, আদি এক গম্বুজ মসজিদটি বহু বছর আগে সংস্কার করে সামনে নামাজের জায়গা প্রসারিত করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। আগে এখানে এত বহুতল ভবন ছিল না। এখন একেকটি বহুতল ভবনেই আগের দিনের প্রায় এক মহল্লার মানুষের বসবাস। ফলে মসজিদের উন্নয়ন করতে হয়েছে। পুরোনো মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভুক্ত রাজধানী তথা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসম্পদ। যদিও তাদের বিশেষ কোনো তদারকি নেই। এমনকি এ বিষয়ে কোনো সাইনবোর্ডও নেই।

ইতিহাসবিদেরা একমত যে, এটিই রাজধানীর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ এবং প্রাক্‌–মোগল যুগের অন্যতম প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন

বিনত বিবির মসজিদের সম্প্রসারিত নতুন ভবনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে। মুসল্লিরা জানালেন, সাততলার ভিত দিয়ে নির্মাণ শুরু হয়। ধাপে ধাপে ছয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। পাশে অজুখানা করা হয়েছে। নিচের তলার মেঝে আর সিঁড়ি মার্বেল পাথরের ফলক দিয়ে মোড়ানো। পরের তলাগুলোতে পাতা হয়েছে উন্নত মানের টাইলস। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বসানো হয়েছে। তবে এখনো সপ্তম তলা আর প্রধান ফটকের কারুকাজ বাকি। ‘বাকিটুকুও শেষ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ’—বললেন তাঁরা।

রাজধানীর এই প্রাচীন মসজিদে পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয় গত সপ্তাহেই। মসজিদের বাইরের দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে। পুরোনো মসজিদটি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। ভেতরে তো প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আগেই পরিষ্কার করা হয়। তারাবির জামাত শুরু হয়ে গেছে। শুক্রবার প্রথম রোজা থেকেই স্থানীয় বাসিন্দাদের দানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে শতাধিক দরিদ্র রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রতি শুক্রবার জুমা নামাজ শেষে থাকবে পবিত্র কোরআনের তাফসির ও রমজানের ফজিলত নিয়ে আলোচনা।

২৪৩ ফুট উঁচু মিনার থেকে ভেসে আসে আজান

বিনত বিবি কে ছিলেন, তার বিস্তারিত জানা যায় না। তবে শত শত বছর অতিক্রম করে ঠিকই টিকে আছে তাঁর একটি কাজ। মানুষের ভালো কাজ এভাবেই মহাকালকে অতিক্রম করে অবিনশ্বর হয়ে ওঠে। আর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তো বলেইছেন, এই পবিত্র রমজান মাসে তিনি বান্দার প্রতিটি ভালো কাজের পুণ্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন।