বাহাদুর শাহ পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান। গতকাল দুপুরে
বাহাদুর শাহ পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান। গতকাল দুপুরে

বাহাদুর শাহ পার্ক নিয়েও বাণিজ্য, ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

বাহাদুর শাহ পার্কের সবুজ চত্বরে নিজের মতো করে কেউ হাঁটবে, বিশ্রাম নেবে, স্বস্তি পাবে—এই সুযোগ সীমিত করে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। মানুষের স্বস্তিতে সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ে না—এমন চিন্তা থেকেই হয়তো ছোট আকারের এই পার্কের ভেতরেও সিটি করপোরেশন খাবারের দোকান ইজারা দিয়েছে। এমনটাই মনে করেন এই পার্ক রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত স্থানীয় বাসিন্দারা।

বাহাদুর শাহ পার্কের আশপাশের বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সিটি করপোরেশনের কাছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি রক্ষা—এসব তেমন গুরুত্ব পায় না। বাণিজ্যিক স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। পুরান ঢাকায় প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা কম। সেখানে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো পার্কের ভেতরে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

পার্ক রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দারের চারটি সংগঠন মিলে গড়ে তোলা হয় ‘ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক ও পার্কের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংগ্রাম পরিষদ’। এই সংগঠন শুরু থেকেই পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান বসানো নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ করে আসছিল। গত আগস্টে পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে তা বন্ধের দাবিতে তারা মানববন্ধন করেছে। এরপর ২১ ডিসেম্বর মেয়র পার্ক পরিদর্শনে এলে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়েও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই পরিষদের সদস্যরা। পার্ক থেকে দোকান সরাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা-৬) ও ঢাকার জেলা প্রশাসককেও স্মারকলিপি দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, বাহাদুর শাহ পার্কে খাবারের দোকান বা ‘ফুড ভ্যান’ চালু করতে ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য ইজারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত কার্যাদেশ দেওয়া হয় ডিএআর হোল্ডিং লিমিটেড নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে।

আন্দোলনে কোনো ফল না আসায় গত নভেম্বর মাসে মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন পার্কের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। এই পরিষদের সদস্যসচিব আখতারুজ্জামান খান গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পার্ক থেকে দোকান সরানোর দাবি জানিয়েছিলেন তাঁরা। মেয়র বিষয়টি দেখবেন বলেছিলেন। কিন্তু দোকান আগের মতোই আছে। দোকানের ভেতরে সারা দিন দুটো চুলা জ্বলায় পার্কের গাছপালা শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার দোকানের কারণে পার্কের পরিবেশ ও সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এই পার্ক রক্ষায় প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান তাঁরা।

বাহাদুর শাহ পার্কের আয়তন ৮৫ দশমিক ৩ কাঠা। এই পার্কের চারপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ অন্তত ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এই পার্ক ব্যবহার করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি সূত্র জানায়, সাঈদ খোকন মেয়র থাকার সময় প্রায় ৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খরচ করে পার্কটি সংস্কার করা হয়। সংস্কারকাজ শেষে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে পার্কটির নবরূপের উদ্বোধন করা হয়।

ইজারার শর্তও ভঙ্গ

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কটির ভেতরে দক্ষিণ দিকে স্টিলের অবকাঠামোর ওপর একটি ঘর রয়েছে। ঘরের ভেতরে তিনটি কক্ষ, মেঝেতে টাইলস বসানো। এসব কক্ষ গুদাম ও রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর পার্কের উত্তর দিকে টিন ও কাঠের আরেকটি অবকাঠামো তৈরি করে সেখানে খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। খাবার বিক্রির কাজ করছিলেন ছয়জন কর্মী। আর রান্নাঘরে কাজে যুক্ত ছিলেন চারজন। রান্নার কাজে যুক্ত এক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, একজনের নামে ইজারা নেওয়া হলেও ‘ফুড ভ্যানের’ মালিক মূলত পাঁচজন। তাঁরা সবাই দেশের বাইরে থাকেন। বেচাবিক্রি বেশ ভালো বলেও জানান তিনি।

ইজারাদার পার্ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন এমন শর্ত দেওয়া হলেও পার্কের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল গতকাল। ফুড ভ্যানের আকৃতি কেমন হবে, তা ইজাদারকে দেওয়া করপোরেশনের কার্যাদেশে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৪-এর প্রকৌশল বিভাগের নির্ধারিত পরিমাপ অনুযায়ী ফুড ভ্যান নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় কার্যাদেশ বাতিলসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৪-এর প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম না প্রকাশের শর্তে দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ইজারাদারকে ভ্রাম্যমাণ দোকান তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এমনভাবে দোকান তৈরি করতে বলা হয়েছিল, যাতে তা যেকোনো সময়ে স্থানান্তর করা যায়। কিন্তু ইজাদার স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করেছেন—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা বলেন, করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পার্কটি পরিদর্শন করেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

বাহাদুর শাহ পার্কটির ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ। পার্কের ভেতর স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে এই বিভাগের প্রধান রাসেল সাবরিন প্রথম আলোকে বলেন, ইজারাদার শর্ত ভঙ্গ করলে তা বাতিলের জন্য তিনি মেয়রের কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন। তবে এই কর্মকর্তা এ-ও বলেন, পার্কটি যাতে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়, তাই ইজারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য পার্কে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হলে গত অক্টোবর মাসেও ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনকে বিষয়টি জানিয়েছিল প্রথম আলো। গত ৯ অক্টোবর ‘বাহাদুর শাহ পার্কে খাবারের দোকান নির্মাণের উদ্যোগ, স্থানীয়দের ক্ষোভ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। এখন ইজারাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে স্থায়ী স্থাপনা ভেঙে ফেলার জন্য বলেছি। তারা ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকান করবে। এ জন্য একটি নকশা করে দেওয়া হয়েছে।’

তবে ওই স্থাপনা ভাঙার কোনো উদ্যোগ সিটি করপোরেশন নেয়নি।

‘কাণ্ডজ্ঞান’ নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস চলতি ডিসেম্বর মাসের ২১ তারিখ পার্কটি পরিদর্শনে যান। সেদিনও পার্কের ভেতর থেকে দোকান সরানোর দাবিতে স্থানীয় বাসিন্দারা কালো পতাকা হাতে বিক্ষোভ করেছিলেন। তবে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে ব্যানার কেড়ে নিয়ে তাঁদের পার্কের সামনে থেকে ওই দিন সরিয়ে দিয়েছিল।

বাংলাপিডিয়া ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই পার্ক আগে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে। এখানে কয়েকজন বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৮৫৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার বিপুলসংখ্যক মানুষের এক সমাবেশে রানি ভিক্টোরিয়ার বিখ্যাত ঘোষণা পাঠ করেন। সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তাঁর নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

ঐতিহাসিক এই পার্কের ভেতর দোকান নির্মাণ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিন দিন আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। এ বিষয়ে গতকাল মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্কের ভেতরে দোকান বসানো—কাণ্ডজ্ঞান থাকলে এটা চিন্তাও করা যায় না। এটা তো কেবল পার্ক নয়, ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। দক্ষিণ সিটির উচিত ছিল এটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। পার্কের যাতে ক্ষতি না হয়, সেটা দেখা মেয়রের দায়িত্ব।’

আনু মুহাম্মদ বলেন, পুরান ঢাকায় খোলা জায়গা নেই। এই পার্ক মানুষের শ্বাস ফেলার জায়গা। সেখানে দোকান বসানোর চিন্তা কেউ কী করে করতে পারে, সেটাই চিন্তার ব্যাপার। সবাইকে এর বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত।