রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনের লক্ষ্যে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় যাত্রীছাউনি। নার্সারি গড়ে তোলায় কাজে আসছে না সেই যাত্রীছাউনি। সম্প্রতি নিকুঞ্জ এলাকায়
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনের লক্ষ্যে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় যাত্রীছাউনি। নার্সারি গড়ে তোলায় কাজে আসছে না সেই যাত্রীছাউনি। সম্প্রতি নিকুঞ্জ এলাকায়

বিমানবন্দর সড়কে নামেই সৌন্দর্যবর্ধন, কাদের–ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারের পকেটে ৫৯ কোটি টাকা

  • কাজ করেছে ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। 

  • সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে ঠিকাদার নিজেই ৯০ কোটি টাকা খরচ করবেন বলে প্রচার করেন। 

  • এক টেলিভিশনের পেছনেই খরচ ৭ কোটি টাকা, সড়কবাতিতে ১৩ কোটি।

টেলিভিশনটি কেনা থেকে শুরু করে রাস্তার পাশে স্থাপন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদারের খরচ সোয়া ৮ লাখ টাকা। শুধু পাহারা দিতেই খরচ ২১ লাখ টাকা। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিরাটাকার টেলিভিশনটি বসানো হয়েছে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে। এত খরচের পরও টিভিটি কিন্তু চলেনি। অলস পড়ে থাকা টিভির গায়ে পড়েছে ধুলার আস্তর।

শুধু কি টেলিভিশন! সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বনানী স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে উড়ালসেতু থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কে বসানো হয়েছে এলইডি বাতি। ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। লতা, পাতা, ফুল ও ঝাউজাতীয় উদ্ভিদ লাগানোর পেছনে ২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসবই মাত্রাতিরিক্ত খরচ। বেশির ভাগই কোনো কাজে আসেনি।

সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বনানী স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে উড়ালসেতু থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

অভিযোগ উঠেছে, কোনো রকম উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর বিমানবন্দর সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনের প্রায় ৫৯ কোটি টাকার কাজ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ওই কাজ পায়। আবেদ মনসুর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

১০ ডিসেম্বর দেখা গেছে, কুড়িল বাসস্ট্যান্ডের কাছে দুটি লোহার দণ্ডের ওপর টেলিভিশনটি বসানো হয়েছে। টেলিভিশনটির ওপর কাগজ ও প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। এর ওপর ধুলার স্তর পড়েছে। এই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী বাড্ডার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম বলেন, বছর দেড়েক আগে টেলিভিশনটি স্থাপন করা হয়। তবে এটি চালু হতে দেখেননি। টেলিভিশনটি কী উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছে এবং এতে কী দেখানো হবে—তা সওজ কর্মকর্তাদের কাছেও পরিষ্কার না।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে চলে যান। ফলে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে সওজের ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন কয়েক মাস আগে। সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেওয়া হয়েছে।

কাদেরের সঙ্গে সখ্য, কাজ পান ঠিকাদার

সওজ সূত্র জানায়, আবেদ মনসুর ভিনাইল ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিলবোর্ড, ব্যানার ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার স্বত্বাধিকারী। নাটকও প্রযোজনা করতেন আবেদ মনসুর। সেই সুবাদে তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। একই সময় ঘনিষ্ঠতা হয় সওজের ঢাকা অঞ্চলের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানের সঙ্গে। সবুজ উদ্দিন খান সওজ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে ওবায়দুল কাদেরের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ওবায়দুল কাদের, আবেদ মনসুর ও সবুজ উদ্দিন খান মিলেই ২০১৭ সালে চীনের সাংহাই বা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের মতো ঢাকার বিমানবন্দর সড়কটি দৃষ্টিনন্দন ডিজিটাল সড়কে রূপান্তরের প্রকল্প নেন।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে আবেদ মনসুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খোলেন। ২০১৭ সালের পর ছয় বছরে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড সওজে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ পায়। যা রীতিমতো বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছেন সওজ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে আমিনবাজার থেকে সাভার পর্যন্ত বাতি লাগানো ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও রয়েছে।

ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গেও সখ্য গড়ে তুলেছিলেন ওই ঠিকাদার। ওবায়দুল কাদেরের প্রভাবে আবেদ মনসুর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কৃষি ও সমবায়বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে ভোট করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।

সরকার পতনের পর আবেদ মনসুর প্রকাশ্যে আসছেন না। তাঁকে ফোন করলেও ধরেননি। সরকার পতনের পর সবুজ উদ্দিন খানকে একটি প্রকল্পে বদলি করা হয়েছে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটি তৎকালীন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে হয়েছে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সরকারের উন্নয়ন প্রচারের জন্য টেলিভিশনটি লাগানো হয়। আবেদ মনসুরের সঙ্গে সখ্যর বিষয়ে সবুজ উদ্দিন বলেন, এটা মানুষ প্রচার করে। তবে ঠিক নয়। চেয়ারে থাকলে সব ঠিকাদারের সঙ্গেই চেনা-জানা থাকে।

আরও স্থাপনা কাজে আসছে না

২০১৯ সালে প্রথম প্রায় ছয় কোটি টাকার একটি কাজ দেওয়া হয় আবেদ মনসুর লিমিটেডকে। এতে সড়কের পাশে স্টিলের বেড়া দেওয়া, খিলক্ষেতে থাকা পদচারী–সেতু ভেঙে দেওয়া এবং সেখানে বাস–বে নির্মাণের কথা বলা হয়। সওজ সূত্র জানায়, খিলক্ষেতের পুরোনো পদচারী–সেতুটি ভাঙতে ৩০ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছেন ঠিকাদার।

সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের আগস্টে প্রায় ১৯ কোটি টাকার আরেকটি কাজ দেওয়া হয় আবেদ মনসুরকে। এই টাকায় বিভিন্ন আকারের ৬৪৭টি সড়কবাতি ও একটি বড় এলইডি টেলিভিশন লাগানো হয়।

সওজের তথ্য বলছে, এলইডি সড়কবাতিগুলো ৯০, ১২০ ও ১৫০ ওয়াটের। সব মিলিয়ে ৬৪৭টি বিভিন্ন সক্ষমতার সড়কবাতি কেনা এবং তা স্থাপন করতে ৪ কোটি টাকার বেশি খরচ দেখানো হয়েছে। বাতিগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কেব্‌ল ও সুইচ কেনা এবং লাইটগুলোর পরিচালনা ব্যবস্থা এবং সফটওয়্যারে জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯ কোটি টাকা।

সৌন্দর্যবর্ধনের নামে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড সর্বশেষ গত বছরের জুনে ৩৪ কোটি টাকার আরেকটি কাজ পায়। এতে সড়ক বিভাজক স্থাপন, ফুটপাত ও নালা নির্মাণ, আধুনিক গার্ডেন বেঞ্চ বসানো, যাত্রীছাউনি নির্মাণ, বাগানে বাতি বসানো এবং গাছ লাগানোর কাজ রয়েছে।

সওজের তথ্য বলছে, বিদ্যমান সড়ক বিভাজক ভাঙতে প্রায় ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন ঠিকাদার। হাইব্রিড বাগানবিলাস, ক্যামেলিয়া, করবী, রঙ্গন, টগর, সুপারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১৬ হাজার ১৯৬টি গাছ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬ লাখ টাকা বেশি। ৬ ফুট উচ্চতার ১ হাজার ৮৬২টি হাইব্রিড ফাইকাস, পাম, চেরি, ঝাউগাছ কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার মতো।

সম্প্রতি দেখা গেছে, সড়কের পাশে যে বাগানের কথা বলা হয়েছে, তা সব জায়গায় নেই। যেখানে আছে, সেগুলোও ঝোপঝাড়ে রূপ নিয়েছে। অধিকাংশ গাছই লতা-গুল্ম কিংবা পাতাজাতীয়। ফুটপাত ও এর পাশে তৈরি বাগানে বসানো হয়েছে ইটের বেঞ্চ। এতে কাউকে বসতে দেখা যায় না। কারণ, ওই এলাকাটি এমনিতেই নির্জন, পথচারী চলাচল করে না।

ঠিকাদারের পাওয়া বিলের তথ্য অনুসারে, ১৫ কোটি টাকার বেশি খরচ করে আটটি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বাস যাত্রীছাউনির সামনে না থেকে অন্যত্র থামছে।

কুড়িলে সড়কের দুই পাশে ক্যাপসুল আকৃতির আরও দুটি ছাউনি তৈরি করা হয়েছে চার কোটি টাকায়। এর মধ্যে বিমানবন্দরমুখী পথের ধারে যে ছাউনিটি তৈরি করা হয়েছে, এর আশপাশে কোনো বাস স্টপেজ নেই। লাগানোর জন্য আনা গাছ সামনে রেখে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ছাউনিটি।

সওজ কর্মকর্তা আসলাম আলী বলেন, তাঁদের নিয়মিত পরিচর্যার লোকবল নেই। প্রয়োজন হলে লোক ভাড়া করে (আউটসোর্সিং) রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

নিজের টাকার গালগপ্পো

সওজ সূত্র জানায়, আবেদ মনসুরের ভিনাইল ওয়ার্ল্ড বিমানবন্দর সড়কের পেছনে ৯০ কোটি টাকা নিজ থেকে খরচ করে সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব নেয়। ১০ বছরে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ আরও ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করবে বলে জানিয়েছিল। কাজটি কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ১৪০ কোটি টাকা সিএসআর হিসেবে সৌন্দর্যবর্ধনে খরচ করবে শুনে তাঁদের সন্দেহ হয়। পরে জানা যায়, বিনিময়ে ওই এলাকায় ১০ বছর বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড ভাড়া দেবে ভিনাইল ওয়ার্ল্ড। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি অনুমোদন পায়নি।

এর আগে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে ২০১৪ সালে ১১৫ কোটি টাকায় বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এবং মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামমুখী সড়কে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছিল। তারও আগে ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ৫৭ কোটি টাকার সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। এর একটা বড় অংশ খরচ হয়েছিল বিমানবন্দর সড়কে। ওই দুই দফায় সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করে ঢাকা সিটি করপোরেশন।

পুরো বিষয়টি আশ্চর্যজনক মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ সৌন্দর্যবর্ধন হয় কোনো উৎসব কিংবা ক্রীড়া টুর্নামেন্টকেন্দ্রিক। কিন্তু এটা মনে হচ্ছে পুরোপুরি ঠিকাদারকেন্দ্রিক। অর্থাৎ একজন ঠিকাদারকে কিছু কাজ দিতে হবে এবং এ থেকে কিছু লোক কমিশন পাবে—এটাই মূল উদ্দেশ্য। এভাবে এলোমেলো, পরিকল্পনাহীন টেলিভিশন আর বাতি লাগিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন হয় না। আর এ কাজ বারবারই হচ্ছে। কেউ দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।