ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

মহড়া চাঁদাবাজি মারধরে নগর ভবনে অস্থিরতা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে নিজেদের প্রভাব দেখাতে দলবল নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে মহড়া দিচ্ছেন বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী। যাঁরা মহড়া দিচ্ছেন, তাঁদের একটি অংশ দরপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার একজন ঠিকাদারের প্রতিনিধিকে মারধর করেছেন। এ ছাড়া গত দুই সপ্তাহে তাঁরা নানাভাবে লাঞ্ছিত করেছেন সিটি করপোরেশনের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচজন কর্মকর্তাকে।

এর বাইরে একজন কর্মকর্তাকে তাঁর কক্ষ থেকে বের করে সবার সামনে মারধর করা হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ চাঁদা আদায় করার তথ্যও পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নগর ভবনে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। অনেকে ভীতির মধ্যে রয়েছেন। এর ফলে দাপ্তরিক কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

দক্ষিণ সিটির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলছে, বিএনপিপন্থী একজন শ্রমিকনেতা করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগের কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছেন তাঁকে না জানিয়ে কাউকে বদলি করা যাবে না। পদোন্নতি ও পদায়ন বন্ধ রাখতে হবে। ওই শ্রমিকনেতা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কর্মী।

ইতিমধ্যে অনেক বড় বড় নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যেসব অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, প্রমাণ পেলে শক্ত হাতে দমন করা হবে।
রুহুল কবির রিজভী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি

অন্যদিকে এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধে লাঠি নিয়ে নামার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গত নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন। ২৮ আগস্ট নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বাজার, মার্কেট, হকার বা অন্য কোনো বাণিজ্যিক এলাকায়/স্থাপনায় আমার অথবা আমাদের দলের নাম ব্যবহার করে চাঁদা চাইলে/দখল করতে চাইলে নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ দিন। আমিও দলের নির্দেশে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে নামব। আর এক মুহূর্ত ছাড় দেওয়া হবে না।’

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর দুদিন আগে গোপনে দেশ ছাড়েন মেয়র (এখন সাবেক) শেখ ফজলে নূর তাপস। সরকার পতনের পর থেকে দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৬৭ জন কাউন্সিলর আত্মগোপনে গেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নকাজের নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন দপ্তর থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কিছু নেতা–কর্মী। তাঁদের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারাও রয়েছেন।

সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এস এম মোশারফ হোসেন, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান ও সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক মেহেদী হাসান নগর ভবন নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, মোশারফ, আরিফুজ্জামান ও মেহেদীর পাশাপাশি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের নেতা সৈয়দ মুকিতুল হাসান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ওমর ফারুক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নূরে আলম ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইহসান মামদুদ তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে নগর ভবনে মহড়া দিচ্ছেন।

সিটি করপোরেশনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রশাসক মহ. শের আলী গত বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অল্প সময়ের জন্য নগর ভবনে যান। পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মারধর ও চাঁদাবাজি

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর করপোরেশনের পরিবেশ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের নগর ভবনে ঢুকতে পারছিলেন না। তিনি সাবেক মেয়র তাপসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ২০ আগস্টের পর নগর ভবনে যাওয়া শুরু করেন। এর মধ্যে একদিন ধাওয়া দিয়ে তাঁকে নগর ভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে চাঁদা দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন তিনি।

একজন শ্রমিকনেতা বলেন, খায়রুল বাকের কাউকে কাউকে টাকা দিয়েছেন। অবশ্য খায়রুল বাকের বলেন, তিনি কাউকে টাকা দেননি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির একাধিক সূত্র বলছে, সংস্থাপন শাখা-৩ এর সহকারী সচিব রোকনুজ্জামানকে ২৫ আগস্ট মারধর করেন মেহেদী ও আরিফুজ্জামানের অনুসারীরা। পরে ২৭ আগস্ট এই কর্মকর্তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়েছে। ওই টাকার ভাগ পাওয়া একজন শ্রমিকনেতা গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এক লাখ টাকা পেয়েছেন।

মারধর ও টাকা দেওয়ার বিষয়ে রোকনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বলে নতুন করে আর ঝামেলায় পড়তে চাই না।’

সিটি করপোরেশনে মহড়া দেওয়া, কর্মকর্তাদের হেনস্তা ও মারধর এবং চাঁদাবাজির বিষয়ে মোশারফ হোসেন, আরিফুজ্জামান, মেহেদী হাসান ও সৈয়দ মুকিতুল হাসানের সঙ্গে গত বুধবার মুঠোফোনে পৃথকভাবে কথা বলেছে প্রথম আলো।

এই চারজনের মধ্যে মুকিতুল বলেন, বৈধভাবে কোনো ব্যবসার সুযোগ আছে কি না, সে জন্য নগর ভবনে এখন যাচ্ছেন।

মেহেদী হাসানের দাবি, আওয়ামী লীগের ‘প্রেতাত্মারা’ তাঁর বিরুদ্ধে নানা প্রচার শুরু করেছে।

আরিফুজ্জামানের দাবি, সংস্থাপন শাখার কর্মকর্তা রোকনুজ্জামানকে তিনি মারধর করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান নির্বাহীকে চিঠি লিখেছিলেন।

কিছু নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, দখল–চাঁদাবাজিতে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে অনেক বড় বড় নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যেসব অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, প্রমাণ পেলে শক্ত হাতে দমন করা হবে।

কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে

ঢাকা দক্ষিণ সিটির নিজস্ব তেলের পাম্প সায়েদাবাদের পৌর ফিলিং স্টেশনের দরপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার নগর ভবনের চতুর্থতলায় মারামারি হয়। এই ফিলিং স্টেশন পরিচালনার জন্য একজন ঠিকাদারের প্রতিনিধি নগর ভবনের সম্পত্তি বিভাগে দরপত্র জমা দিতে এলে হামলা চালানো হয়।

হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে যুবদল নেতা সৈয়দ মুকিতুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মারামারির ঘটনা শুনে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি সূত্র বলছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী বোরহান উদ্দিনসহ অনেক কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে তাঁদের হেনস্তা করা হয়েছে।

করপোরেশনের একটি বিভাগের দায়িত্বে থাকা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির কিছু নেতা–কর্মী করপোরেশনের যে অবস্থার সৃষ্টি করছেন, তাতে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ঠিকাদারি, ইজারাসহ নানা সুবিধা দিতে চাপ দিচ্ছেন তাঁরা। এভাবে চলতে পারে না।