রমনা পার্কে প্রাণিকুলের সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে হাবিবুর রহমানের
রমনা পার্কে প্রাণিকুলের সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে হাবিবুর রহমানের

‘মাত্র ২০ টাকায় কত আনন্দ কেনা যায় মানুষ জানে না’

একহারা গড়নের হাবিবুর রহমান দেখতে সাদামাটা। বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। রক্তে শর্করা বাড়ছে বলে হাঁটাহাঁটি বাড়িয়েছেন।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাবিবুর রাজার দেউড়ি এলাকা থেকে হেঁটে চলে আসেন রমনা পার্কে। আবার হেঁটেই ফেরেন।

তবে রমনা পার্কের অন্যান্য ভ্রমণকারীর সঙ্গে হাবিবুরের পার্থক্য হচ্ছে, এখানকার প্রাণিকুলের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক।
অধিকাংশ সময় হাবিবুর রমনা পার্কের কাকরাইল মসজিদের কাছের একটি বেঞ্চে বসেন। ওদিকটায় তুলনামূলক শব্দ কম। শাহবাগ-ঘেঁষা দিকটায় মানুষ ও যানবাহনের শব্দ বেশি।

তবে হাবিবুর রমনায় প্রবেশ করেন রীতিমতো ‘অভ্যর্থনা’ পেয়ে। অরুণোদয় হোক অথবা অস্তাচলের গেট—যখনই যে পথ দিয়ে যান রমনায়, একেবারে মূল ফটক থেকেই তাঁকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন কান পাতলে শোনা যায় বিচিত্র এক দলগত শব্দ। হাবিবুরকে স্বাগত জানানোর শব্দ এটা।

হাবিবুর রমনায় ঢুকলে তাঁর মাথার ওপরে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে পাখিরা। তারা যেন বুঝে যায়, এসে গেছে আপনজন। তখন কোনো কোনো গাছের ডাল থেকে সরসর করে লেজ উঁচু করে নেমে আসে কাঠবিড়ালি। পায়ে পায়ে হাঁটে ওরা, কোলে উঠে বসতে চায় হাবিবুরের।

বিস্কুট গুঁড়া করে কাঠবিড়ালিকে দিয়েছেন হাবিবুর রহমান

হাবিবুর প্রথম আলোকে বললেন, ‘শালিক আর কাক কিন্তু মানুষ ভয় পায়। আমি যদি খাওন না দিই, ওরা আমার পেছন পেছন হাঁটে। জানে, খাওন আমি ঠিকই নিয়া আসছি। মনে হয় লুকায় রাখছি। কাঠবিড়ালিগুলো কোলে উঠপার চায়। তয় আমি কিন্তু এগুলা নিজের মনের আনন্দে করি। ওগোরে ভালোবাসি বইলা করি। তাই দেখাইবার চাই না।’

হাবিবুর যে কাজটি আসলে পশুপাখিদের ভালোবেসেই করেন, তা আরও স্পষ্ট হলো গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর অনীহা দেখে। এমনকি এই সংবাদ কেন করতে হবে, এ প্রশ্নও করে বসেন তিনি। গণমাধ্যমের ক্যামেরা যেতে পারে শুনলে তিনি সেদিন পার্কের ওই জায়গায় যান না বলেও জানালেন। বললেন, ‘ভালো লাগে বইলা করি। কিন্তু মানুষ, ক্যামেরা—এই সবের জটলা হইলে পাখি, কাঠবিড়ালি ভয় পাইব। ডিস্টার্ব না কইরা অগরে ওগোর মতো থাকতে দেওয়া উচিত। আমি আমুই না জানলে।’

মানুষের জটলা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও প্রকৃতির টান হাবিবুরের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। জানালেন, অনেক দূরের পথ বলে মাঝেমধ্যে রমনা পর্যন্ত আসা হয় না। কিন্তু তখন রাতে ঘুমের মধ্যে মনে হয়, আহা এই পাখিরা, কাঠবিড়ালি ওরা নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিল তাঁর জন্য। ওরা জানে, তাঁর যাওয়া মানেই খাবার পাওয়া। এসব ভেবে পরদিন ভোরে আবার ছুটে যান রমনায়।

রমনা পার্কের বেঞ্চে বসে থাকা হাবিবুর রহমানের পাশে ঘুরঘুর করছে কাঠবিড়ালি ও কাক

রমনার প্রাণিকুল নিয়ে হাবিবুরের এই প্রসঙ্গটি প্রথম উঠে আসে আলোকচিত্রী আক্কাস মাহমুদের একটি পোস্টে। ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি হাবিবুরকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, ‘আপনাকে আমাকে দেখলে দৌড় দিবে এই প্রাণিকুল! কিন্তু তাঁর পাশে বসে আয়েশ করে নির্ভয়ে বিস্কুট খাবে এরা।’

এরপর প্রথম আলোর আলোকচিত্রী দীপু মালাকার যান হাবিবুরের ছবি তুলতে। এরপর হাবিবুরের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয় গত মাসের শেষ দিকে।

আক্কাস মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রমনায় একদিন ভোরে তিনি প্রথম দেখেছিলেন এই মানবিক দৃশ্যটা। পা ঝুলিয়ে বেঞ্চে বসে থাকা একজন মানুষ পাখিদের খাবার দিচ্ছেন।

এরপর নিজের আগ্রহ থেকে আলাপ করে আক্কাস মাহমুদ জানতে পারেন, করোনার মহামারির সময় রমনায় প্রাতর্ভ্রমণকারীদের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে যায়। শুরু হয় সেখানকার প্রাণীদের খাবারের অভাব। এই পরিস্থিতিতে বিস্কুট এনে রোজ ওদের খাওয়াতে শুরু করেন হাবিবুর। করোনা চলে গেলেও সেই অভ্যাস আর যায়নি তাঁর। বরং দিন দিন মায়া বাড়ছে। ওরাও আপন করে নিয়েছে হাবিবুরকে। তিনি এলে যেভাবে ছোটাছুটি করে এসে কাছে জড়ো হয়, তাতে বোঝা যায়, ওরাও অপেক্ষা করে মানুষটির জন্য।

হাবিবুর রহমান রমনায় ঢুকলেই যেন পাখি ও কাঠবিড়ালিরা বুঝে যায়, আপনজন এসে গেছে

হাবিবুরের একমাত্র ছেলে জামিলুর রহমান। পড়ছে নটর ডেম কলেজে। হাবিবুরের রাজার দেউড়ি এলাকায় এখন কোনো পশুপাখি নেই। তবে একসময় তিনি অনেক কবুতর পালতেন। একসঙ্গে ৫০ থেকে ৬০টি কবুতরও তিনি পুষেছেন।

এখন এই শহরে জায়গা কমে আসছে, মানুষই থাকতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন হাবিবুর। বলেন, একসময় পুরান ঢাকার বাড়িগুলো ছিল দু-এক তলার। তখন বানর থেকে শুরু করে আরও অনেক রকম প্রাণীর সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এখন ছয়-সাত তলা ভবনগুলোতে মানুষের সঙ্গে পশুপাখির সহাবস্থানের কথা কল্পনারও অতীত।

রমনায় রোজ ওদের জন্য কী খাবার নিয়ে যান, জিজ্ঞেস করলে হাবিবুর জানান, নোনতা স্বাদের একধরনের বিস্কুট। বিস্কুটটা সহজে গুঁড়া হয়ে যায়। পাখি, কাঠবিড়ালিরা বেশি পছন্দ করে এটা।

কত টাকার খাবার কেনেন প্রতিদিন, জানতে চাইলে হাবিবুর বলেন, ‘মাত্র ২০ টাকার। ২০ টাকায় কত আনন্দ কেনা যায়, মানুষ জানে না। জানলে পার্কে হাঁটতে আসা আরও অনেকে রোজ পাখি-কাঠবিড়ালির জন্য খাবার নিয়া আইত। আর ওরাও মানুষরে কম ভয় পাইত।’