অতিঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিরুনি অভিযানে নেমেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ অভিযানের প্রথম দিন আজ মঙ্গলবার দুটি বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়ার পর জরিমানা আদায় করতে চলে যায় পৌনে দুই ঘণ্টা। ফলে অন্য দিনের চেয়ে মশা মারার ওষুধ কম ছিটানো হয়েছে। সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে।
তিন ঘণ্টার এই চিরুনি অভিযান সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বেলা ১টায় শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে পুরান ঢাকায় ওয়ারী এলাকায় সকাল সাড়ে ১০টায় ১৩ মশককর্মীকে নিয়ে এ অভিযান শুরু হয়। এরপর বেলা পৌনে ১১টায় টিপু সুলতান রোডের একটি নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা খুঁজে পান অভিযান পরিচালনাকারী দলের সদস্যরা। পরে ভবনমালিককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
তবে এ জরিমানার টাকা আদায় করতে সময় লাগে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। এই পুরো সময় মশককর্মীরাসহ অভিযান পরিচালনাকারী দলের সদস্যরা ভবনটি সামনেই অবস্থান করেন। এক বাড়িতে এত সময় ধরে অপেক্ষা করার বিষয়ে অভিযানে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শফিউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, জরিমানার টাকা জোগাড় করতে তো সময় লাগে।
এরপর পাশের লারমিনি স্ট্রিটে ২৫/৪ নম্বর বাড়িতে গিয়ে মশার লার্ভা পাওয়া যায়। সময় তখন ১১টা ৫৫ মিনিট। এরপর জরিমানার ৩০ হাজার টাকা আদায় করতে প্রায় ৩৫ মিনিট অপেক্ষা করেন করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে ভবনমালিক উপস্থিত না থাকায় টাকা ছাড়াই সেখান থেকে তাঁরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বের হন।
নির্মাণাধীন ভবনটির মালিক মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি উপস্থিত না থাকায় নির্মাণশ্রমিক বাচ্চুকে সঙ্গে রাখেন অভিযানে থাকা আনসার সদস্যরা। এ সময় বাচ্চু সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের স্থাপনায় আগে পানি ছিল না। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে কিছুটা পানি জমেছে। সেচযন্ত্র দিয়ে তাঁরা পানি অপসারণ করছেন।
এই স্থাপনায় আগে মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে নির্মাণশ্রমিক বাচ্চু বলেন, মাঝেমধ্যে ধোঁয়া (ফগিং তথা উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ ছিটানো) দেখেছেন, সকালে ওষুধ ছিটাতে (অ্যাডালটিসাইডিং তথা মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার জন্য যে ওষুধ ছিটানো হয়) দেখেননি।
এডিস মশার উৎপত্তিস্থল নির্মূলে আজ থেকে দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান শুরু হয়েছে। ওয়ারীর বলধা গার্ডেনের দক্ষিণ পাশের সড়কে তিন দিনের এ অভিযানের প্রথম দিনের কার্যক্রম আজ উদ্বোধন করেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। করপোরেশনের মশককর্মীদের পাশাপাশি ওই এলাকার কাউন্সিলর (৪১ নম্বর ওয়ার্ড) সারোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
চিরুনি অভিযানের বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ এই অভিযানের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ওয়ার্ডে যত কর্মী রয়েছেন, তাঁরা সবাই সকালে ও বিকেলে একসঙ্গে মশার ওষুধ ছিটাবেন। যেমন প্রতিটি ওয়ার্ডে সকালে ছয়জন ও বিকেলে সাতজন কর্মী কাজ করেন। চিরুনি অভিযানের সময় সকালে ১৩ জন ও বিকেলে ১৩ জন একসঙ্গে মশার ওষুধ ছিটাবেন।
ডিএসসিসির চিরুনি অভিযানের পুরোটা সময় এই প্রতিবেদক উপস্থিত ছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ওষুধ ছিটাতে বাসাবাড়ি পরিদর্শন শুরু করেন। বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে ছিলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। মশককর্মীদের ওষুধ না ছিটিয়ে বরং কর্মকর্তাদের প্রটোকল দেওয়ায় বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
চিরুনি অভিযানে যে কর্মীরা অংশ নেন, তাঁদের কেউই ওষুধ শেষ করতে পারেননি। ওষুধ শেষ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে এক কর্মী বলেন, ‘প্রোগ্রামের লগে লগে যামু নাকি ওষুধ ছিটামু। স্যারগো লগে লগেই তো ঘুরছি। ওষুধ ছিটামু কেমনে।’ একই প্রশ্নে আরেক কর্মী বলেন, ‘এক বাড়িতেই তো এক ঘণ্টা চলে যাচ্ছে।’
দুই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করতেই পৌনে দুই ঘণ্টা সময় লাগার বিষয়ে দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, জরিমানা করার পর স্থাপনার মালিকদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দুটি বাড়ির মধ্যে একটির তত্ত্বাবধায়ক শৌচাগারে লুকিয়ে ছিলেন।
আরেক বাড়ির মালিককে বেলা দেড়টা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই কিছুটা সময় লেগেছে।
মশার ওষুধ না ছিটিয়ে মশককর্মীদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকার বিষয়ে করা অপর প্রশ্নে ফজলে শামসুল কবির বলেন, বিনা কারণে কেউ থেকে থাকলে তাঁরা অন্যায় করেছেন। তাঁদের ওষুধ ছিটাতে বলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে যাতে একজন মশককর্মী থাকেন, তা বলে দেওয়া হবে।
২১টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ। এর সঙ্গে আমরা আরও চারটা ওয়ার্ডকে যুক্ত করে ২৫টি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান শুরু করেছি।মো. মিজানুর রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিএসসিসি
সরেজমিনে দেখা যায়, চিরুনি অভিযান শুরুর পর অন্তত ১০ কর্মী অভিযানে থাকা করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পেছনে পেছনে ঘোরেন। সুযোগ পেলেই কেউ ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেন। কেউ দোকানে চা খান। কেউ কেউ স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারীদের সঙ্গে খোশগল্প করেন।
এদিকে অভিযান চলাকালে ওয়ারী এলাকার এক বাসিন্দা মশার ওষুধ না ছিটানোর অভিযোগ করেন।
আহমেদ মাসুদুল হক নামের ওই ব্যক্তি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর বাসার গলিতে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। পরে এক মশককর্মী গিয়ে তাঁর স্থাপনাসহ আশপাশে ওষুধ ছিটিয়ে আসেন।
এর আগে চিরুনি অভিযান শুরুর আগমুহূর্তে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘২১টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ। এর সঙ্গে আমরা আরও চারটা ওয়ার্ডকে যুক্ত করে ২৫টি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান শুরু করেছি।’
ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে, এটা সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন কি না, এমন প্রশ্নে করপোরেশনের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘জীবনের মূল্য সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।’