মাটি পাচারকারীদের ডাম্পারের (মিনি ট্রাক) চাপায় খুন হওয়া বনবিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামানের (৩০) বড় ভাই মো. কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘এলাকার সবাই জানেন কারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, তারপরও আসামিরা অ্যারেস্ট হচ্ছে না কেন? এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমি ভাইয়ের লাশ দেখেছি। আমি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই। ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্য কোনো ঘটনা সামনে আসায় ভাইয়ের হত্যার ঘটনা যাতে চাপা পড়ে না যায় তা–ও চাই।’
‘বন কর্মকর্তার হত্যার বিচার, বন ও পাহাড়খেকোদের গ্রেপ্তার এবং বন-পাহাড় রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার’ দাবিতে নাগরিক সমাবেশে কামরুজ্জামান এসব কথা বলেন। আজ মঙ্গলবার বিভিন্ন পরিবেশবাদী, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বন অধিদপ্তরের সামনে এ সমাবেশ হয়।
এ সমাবেশেই প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বললেন, ‘সাজ্জাদুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে, এ হত্যার বিচার চাই। অজ্ঞাতনামা নয়, ১০ জন আসামির নাম উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট মামলা হয়েছে। এই আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।’
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, বন রক্ষায় যে কর্মীরা কাজ করেন, তাঁরা কতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করেন, তা ঢাকায় বসে কল্পনা করাও সম্ভব না। তাঁরা রাতের আঁধারে ঝুঁকি নেন। এই কর্মীরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। কর্মীদের সুরক্ষায় ঝুঁকিভাতা নিশ্চিত করাসহ সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নেবেন বলেও তিনি জানান।
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বন সংরক্ষণে জনবল স্বল্পতা, কোর্টে ও থানায় যেসব মামলা করা হচ্ছে বিশেষ করে সংবেদনশীল মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়াসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন। তিনি জানান, ২০২০ সালে মহেশখালী বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ইউসুফ উদ্দীন পাহাড় ও বনখেকোর হাতে হত্যার শিকার হন। আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে, মামলাটি চলমান আছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় বন রক্ষায় অভিযান চালাতে গিয়ে মাটি পাচারকারীদের ডাম্পারের (মিনি ট্রাক) চাপায় খুন হন বনবিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান (৩০)। ৩০ মার্চ শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় ফরিদ আলমের দোকানের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। পাশের উপজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ওই ডাম্পারটি আটক করে জনতা। সাজ্জাদুজ্জামান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বনবিটের দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন বিভাগে যোগদান করেন সাজ্জাদুজ্জামান।
মুন্সিগঞ্জের সাজ্জাদুজ্জামান আড়াই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার মুমতাহেনা সুমিকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে মাবির শাহ (সাদিকা) নামে ৯ মাস বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। সমাবেশে সাজ্জাদুজ্জামানের স্ত্রী এবং মেয়েও উপস্থিত ছিল। বাবা হত্যার কিছু না বুঝলেও প্রচণ্ড গরমে ৯ মাস বয়সী মেয়ে কাঁদছিল। সমাবেশের বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বাবা হত্যার বিচার কি পাবে শিশু সাদিকা’, ‘সাদিকার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে’, ‘জাস্টিস ফর সজল’...। সমাবেশে সাজ্জাদুজ্জামানের বাবা ও মা উপস্থিত ছিলেন, তবে কথা বলেননি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির সমাবেশে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বাপার সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার।
সমাবেশ শুরুর আগে এবং শেষে সমাবেশ আয়োজনকারী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। এ ছাড়া প্রধান বন সংরক্ষক সমাবেশেও বক্তব্য দেন। সমাবেশে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা প্রধান বন সংরক্ষকের হাতে পাঁচ দফা দাবিনামা তুলে দেন।
সমাবেশ শেষে আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী সাজ্জাদুজ্জামানের হত্যার ঘটনায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। কল্যাণ তহবিল থেকে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ঈদের আগেই বন ভবনের কর্মীদের এক দিনের বেতন দিয়ে সাজ্জাদুজ্জামানের পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন বলেও জানিয়েছেন।
সমাবেশে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবিগুলো পড়ে শোনান বাপার যুগ্ম সম্পাদক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। দাবিগুলো হচ্ছে সাজ্জাদুজ্জামানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, সাজ্জাদুজ্জামান ও মহেশখালী বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ইউসুফ উদ্দীনের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আহত বন কর্মকর্তার চিকিৎসা নিশ্চিত করা, কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং বনভূমি, পাহাড় ও নদী রক্ষায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সমাবেশে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পাহাড়, বন রক্ষায় সরকার উদাসীন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পাহাড় আর বন রক্ষাকে সংবিধানে সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ সাজ্জাদুজ্জামানের পরিবারকে এমন হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু কেন মেনে নেবে পরিবার? আগের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামিরা জামিন পেয়ে গেছে। এই মৃত্যুগুলোকে অসহায় মৃত্যু হিসেবে মেনে নিলে জবাবদিহির আর কোনো জায়গা থাকবে না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কথা বলছি বহুদিন ধরে। সরকার প্রথম থেকেই এদের নিয়ন্ত্রণ করলে এমন পরিস্থিতি হতো না। আমার–আপনার কাছে না থাকলেও সরকারের কাছে কারা এসব করছে তার তালিকা আছে। অনেকের নাম সামনে এলেও সরকার শাস্তি দিতে চায় না। আর সাজ্জাদুজ্জামানের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে এমন ঘোষণা দিলেই হবে না, ঈদের আগেই জানতে চাই সরকারিভাবে পরিবারটির জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো।’
সমাবেশে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। সবার চাওয়া একটাই, সাজ্জাদুজ্জামানের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর কেউ ঘটানোর সাহস না পায়।
ঘটনার পর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে উখিয়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, গভীর রাতে হরিণমারা পাহাড় কেটে ডাম্পারে ভরে বালু পাচার হচ্ছিল। খবর পেয়ে সাজ্জাদুজ্জামান মোটরসাইকেলচালক মো. আলীকে (২৭) নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় বালু পাচারকারীরা ডাম্পার দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী সাজ্জাদ ও আলীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যান। এতে মাথা ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাজ্জাদ। গুরুতর আহত অবস্থায় উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তার চালক আলীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।