অতুল রোজারিও ও এগনেজ এরামচেটি দম্পতির মেয়ে অনিলা রোজারিওর বয়স সাড়ে তিন বছর। তাঁরা থাকেন রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকায়। মেয়ের জ্বর আসার এক দিন পর রক্ত পরীক্ষা করানো হয়। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে মেয়েকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন তাঁরা। পরে সেখান থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান তাকে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চার দিন থাকার পর ১২ জুলাই ঢাকা শিশু হাসপাতালে মারা যায় অনিলা। এখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত দুই বছর এক মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর আরেকটি হাসপাতালে কাটাচ্ছেন এই দম্পতি।
জানুয়ারি থেকে গত মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) পর্যন্ত ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২৭১ শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু। যা মোট ভর্তি শিশুর ৩৫ দশমিক ৮ ভাগ। এ ছাড়া ভর্তি শিশুদের মধ্যে শূন্য থেকে এক বছর বয়সী শিশু ১১ দশমিক ৪ ভাগ, ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী ৩২ দশমিক ১ ভাগ এবং ১০ বছরের ওপরে ২০ দশমিক ৭ ভাগ শিশু।
এই বয়সী শিশুরা ডেঙ্গুতে কেন বেশি আক্রান্ত হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যাদের চলাফেরা কম, তাদেরই মশা বেশি কামড়ায়। আর এডিস মশা দিনে কামড়ায়। এক থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চারা বেশি বাসায় থাকে। দেখা যায়, সকাল বেলায় মা ঘুম থেকে উঠে গেলে বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকছে। অনেক সময় মশারি খুলে দেওয়া হলে তখন সন্তানকে মশা কামড়াতে পারে। দুপুরে বাচ্চারা ঘুমায়, তখনো অনেকে মশারি ব্যবহার করেন না। এ সময়ও শিশুকে মশা কামড়ায়।
আবদুল মোমেন ও ফারজানা ফেরদোসী দম্পতির দুই বছর পাঁচ মাস বয়সী মেয়ে মানহা মাহজাবিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি। মিরপুর–১০ নম্বরের সেনপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফারজানা ফেরদোসী প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী–স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। তাঁদের বাসায় মশা নেই। তাই ছুটির দিনে বাসায় থাকলে দিনের বেলায় কখনো মশারি টানাতেন না, মেয়ে ঘুমালেও না।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক কামরুজ্জামান বলেন, ছোট বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। এ জন্য ডেঙ্গু হলে শিশুদের ঝুঁকি বেশি। তা ছাড়া স্থূলতা, কিডনি, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যার মতো নানা রোগে আক্রান্ত শিশুরা আরও বেশি ঝুঁকিতে। ফলে এ সময়ে জ্বর দেখা দিলে প্রথম দিনই শিশুদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং ডেঙ্গু হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করাতে হবে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু নিয়ে শিশুরা ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকে। প্রথম দিকে শিশুর সংখ্যা কমই ছিল। তবে জুন মাস থেকে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুনে ৬৩টি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশু এখানে ভর্তি হয়। আর জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই ভর্তি হয়েছে ১৭২টি শিশু।
চাপ বাড়ায় ১৪ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তাতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ৪২ আসন বিশিষ্ট ২ নম্বর ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বরাদ্দ দেয় হাসপাতালটি। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তাই ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের ভর্তি করা হচ্ছে।
এক দিনে এই হাসপাতালে সর্বোচ্চ ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল গত শনিবার। বুধবার পর্যন্ত ৬২ শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে ৯টি শিশু আইসিইউতে।
রোগী বাড়ায় মৃত্যুও বেড়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে শিশু হাসপাতালে তিনটি শিশু মারা গেছে। গত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুতে ভরা ২ নম্বর ওয়ার্ড। সব শিশুর জন্যই শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুদের সামলাতে বাবা–মায়েরা অস্থির সময় পার করছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর চাপ এখন পর্যন্ত আমরা সামলাতে পারছি। রোগীর চাপ আরও বাড়লে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকেরা বলছেন, শিশুদের কারও কারও ক্ষেত্রে আগে জ্বর আসছে। আবার কারও কারও আগে পাতলা পায়খানা ও বমি হচ্ছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত পাঁচ বছর তিন মাস বয়সী ছেলে আরহাব হাসিন জারিফকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছেন মোছা. জোসনা আক্তার। তিনি বলেন, তাঁর ছেলের গত শুক্রবার বমি ও পেটে ব্যথা ছিল। শনিবার সকাল থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় জ্বর আসে।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে আসা মো. সজীব বলেন, ১১ মাস বয়সী ছেলের প্রথম থেকেই জ্বর। সে দুই দিন পরপর পায়খানা করছে।
বাচ্চাদের ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষায় বাসায় সুতির ফুলহাতা জামা, পাজামা ও মোজা পরানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, বাসা ও আশপাশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যেন মশা জন্মাতে না পারে।