গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ শুরু করেছে রাজউক। দাম যেমন বেশি, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানি তোলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকা ওয়াসা পূর্বাচলে পানি সরবরাহ করতে রাজি হয়নি।
পিপিপির মাধ্যমে পানি সরবরাহের প্রকল্প নিয়েছে রাজউক।
রাজউক সম্প্রতি পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ শুরু করেছে। তবে সংস্থাটি পানির যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা ঢাকা ওয়াসার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেকটা বেশি।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেওয়া পানির দাম তুলনা করে দেখা যায়, পূর্বাচলের বাসিন্দাদের আবাসিক শ্রেণিতে পানির দাম ৩১ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ৭ শতাংশ বাড়তি দেওয়া লাগবে। অবশ্য রাজউক বলছে, ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় করেই পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ কমাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে পূর্বাচল নতুন শহর। এতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। এই শহর গড়তে রাজউকের নেওয়া প্রকল্প ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় সেখানে এখনো বসতি গড়ে ওঠেনি। তবে পূর্বাচলে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাচলে এখন পর্যন্ত ২৯০টি বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আবেদন পড়েছে ৩১৩টি।
গভীর নলকূপ দিয়ে তোলার কারণে ঢাকার বিভিন্ন অংশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বাড়ে।আদিল মুহাম্মদ খান, নির্বাহী পরিচালক, আইপিডি
রাজউকের কর্মকর্তারা জানান, পূর্বাচলের ৩০টি সেক্টরের মধ্যে আপাতত ১, ২, ৩ নম্বর সেক্টর এবং ৪ নম্বর সেক্টরে (আংশিক) দুটি গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই চার সেক্টরে প্লট আছে প্রায় তিন হাজার। এসব প্লটের মালিকেরা চাইলে পানির সংযোগ নিতে পারবেন। গত ৩০ জানুয়ারি থেকে ২০টি পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আরও পাঁচটি সংযোগের আবেদন জমা পড়েছে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, পূর্বাচলে পানি সরবরাহ করার কথা ছিল ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওয়াসা অপারগতার কথা জানায়। পরে রাজউক পানি সরবরাহে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) প্রকল্প নেয়।
রাজউকের পানি সরবরাহ–সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আবাসিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা। ঢাকা শহরের অন্যান্য এলাকায় একই পরিমাণ পানি সরবরাহের জন্য ঢাকা ওয়াসা নেয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম হবে ৪৫ টাকা, যা ঢাকা ওয়াসার চেয়ে ৩ টাকা বেশি।
পানির দাম বেশি হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে পূর্বাচল পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক মো. বদিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সাত সদস্যের একটি কমিটি পানির দাম নির্ধারণ করেছে। পূর্বাচলে পানির সংযোগ এখন কম, সেই তুলনায় পরিচালন ব্যয় বেশি। এ বিবেচনায় ভর্তুকি মূল্যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, পূর্বাচল এলাকায় পানি সরবরাহ–সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হলে পানির সংযোগ না নিলেও প্লটের মালিকদের ন্যূনতম একটি ফি দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ মেটানোর জন্য এটি করা হতে পারে বলে রাজউক সূত্র জানিয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্প এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করবে রাজউক। পরের ১১ বছর পানি সরবরাহ–সংক্রান্ত প্রকল্পটি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৯২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাজউক বিনিয়োগ করবে ২৯৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাকি টাকা বিনিয়োগ করবে ইউনাইটেড ড্যালকট ওয়াটার লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মোট চারটি পর্বে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
রাজউক বলছে, অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হলে প্রকল্পের আয় থেকে প্রতিবছর ইউনাইটেড ড্যালকটকে ৫৭ কোটি টাকা করে দেওয়া হবে। ১১ বছরে ৬২৭ কোটি টাকা পাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পুরো পূর্বাচলকে ১৫টি অঞ্চলে (ডিস্ট্রিক্ট মিটারড এরিয়া বা ডিএমএ) ভাগ করা হয়েছে। ১৫টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুলে সেটি সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্পের পরিচালক মো. বদিউল আলম জানান, ২০৩৫ সালের পর ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে সরবরাহ করার পরিকল্পনা আছে রাজউকের।
এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সারা বিশ্বেই গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহকে পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঢাকা ওয়াসাও টেকসই পানি সরবরাহের জন্য গভীর নলকূপের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে সরবরাহ করার দিকে জোর দিচ্ছে। এমন অবস্থায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পূর্বাচলে পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগর–পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।
তিনি বলেন, গভীর নলকূপ দিয়ে তোলার কারণে ঢাকার বিভিন্ন অংশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বাড়ে। এ জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে সরবরাহ করার প্রতি জোর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, রাজউকের উচিত ছিল পূর্বাচলের আশপাশের নদ-নদীগুলো দূষণমুক্ত রেখে সেখান থেকে পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া।