ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগো
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগো

ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র ও কাউন্সিলরা নেই, স্থবির ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়ররা এক সপ্তাহ ধরে কার্যালয়ে আসছেন না। হদিস নেই ১১৮ কাউন্সিলরেরও। এ অবস্থায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অফিসে আসা-যাওয়া করলেও মেয়রদের অনুপস্থিতির কারণে করপোরেশন দুটির সব কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী বছর হওয়ায় এবার দুই সিটিতে বিগত বছরের চেয়ে বেশি উন্নয়নকাজ শুরু করার পরিকল্পনা ছিল; পাশাপাশি নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজও রাখা হয়েছিল অগ্রাধিকারে। সব মিলিয়ে তিন হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল দুই সিটিতে। কিন্তু এসব কাজ চালিয়ে নিতে প্রশাসনিক ও আর্থিক অনুমোদন প্রয়োজন, যার এখতিয়ার শুধু মেয়রদের।

শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন চলার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট ভোরে অনেকটা গোপনে দেশ ছাড়েন। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর পর থেকে উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও কার্যালয়ে আসছেন না।

শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন চলার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট ভোরে অনেকটা গোপনে দেশ ছাড়েন। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর পর থেকে উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও কার্যালয়ে আসছেন না।

ইতিমধ্যে দুই সিটির ১২৯ কাউন্সিলরের মধ্যে ১১৮ জনও আত্মগোপন করেছেন। আবার বেশির ভাগ কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হয় আগুন দেওয়া হয়েছে, না হয় ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে। এ জন্যও করপোরেশনের সেবা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।

বশীর উদ্দিন উত্তর সিটির অধীন পূর্ব রাজাবাজার এলাকার বাসিন্দা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধন সনদে তাঁর ছেলের নাম সংশোধন করা দরকার। কিন্তু কাউন্সিলরকে না পাওয়ায় তা করতে পারছেন না। আবার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকেও বলা হয়েছে, এ কাজ কাউন্সিলরের মাধ্যমেই করতে হবে। এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তিনি।

মেয়রদের অনুপস্থিতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।
মিজানুর রহমান, ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

ঢাকার দুই মেয়রের দায়িত্ব পালনের শেষ অর্থবছর চলছে এখন। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে সিটি নির্বাচনের আলোচনা উঠেছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই মেয়র কার্যালয়ে ফিরবেন কি না, তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। তাঁরা দায়িত্বে না ফিরলে প্রশাসন কীভাবে চলবে, তা জানতে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।


ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়রদের অনুপস্থিতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।

দপ্তরগুলোর ভেতরেও অপ্রীতিকর অবস্থা

এদিকে করপোরেশনের বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেয়রদের অনুপস্থিতির কারণে বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে হট্টগোল করছেন। কর্মকর্তাদের অনেককে দেখে নেওয়ারও হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দুই সিটির ১১৮ কাউন্সিলরও আত্মগোপন করেছেন। আবার বেশির ভাগ কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হয় আগুন দেওয়া হয়েছে, না হয় ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে। এ জন্যও করপোরেশনের সেবা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।

দক্ষিণ সিটির সংস্থাপন শাখার একজন সহকারী সচিব নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ এক যুবক তাঁর দপ্তরে এসে খারাপ আচরণ করতে থাকেন। তাঁকে কেন চাকরি দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে শাসিয়ে গেছেন।

উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তাও নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের বিভাগের এক কর্মকর্তার চাকরি অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর ওই কর্মকর্তা এসে অন্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে গেছেন। মেয়র না থাকার কারণে তাঁরা অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়ছেন।

হাজার কোটি টাকার কাজ স্থবির

দুই সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, যেকোনো ক্রয়, নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, বোর্ড সভা ও দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়নকাজের অনুমোদন, কাজের বিল, নিরাপত্তা জামানত, আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজের অনুমোদনসহ সব বিষয়েই মেয়রদের সই দরকার হয়। এখন তাঁরা না আসায় সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তাঁরা শুধু অফিসে আসা-যাওয়া করছেন।

উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, সংস্থাটিতে বর্তমানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলমান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসব কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া মেয়র না আসায় উন্নয়নকাজের জন্য প্রক্রিয়াধীন দরপত্রগুলোর অনুমোদন নেওয়া যাচ্ছে না। কাজের চলতি বিলগুলো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। আবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় যেসব উন্নয়ন–পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেসব বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল; ছিল এলাকাভিত্তিক রাস্তাঘাট উন্নয়নের পরিকল্পনাও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার কাজ শুরুর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেত। কিন্তু সব স্থবির হয়ে গেছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, বিভিন্ন এলাকায় সংস্থাটির প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজ চলমান। কিন্তু গত মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরুর পর থেকেই এসব কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে জলাবদ্ধতা নিরসনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে আরও ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। মেয়র না আসায় এসব কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

সেপ্টেম্বরের মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজের দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ করতে না পারলে আগামী বছর ঢাকায় আবার জলাবদ্ধতার ভোগান্তি হবে বলে মনে করছেন দুই সিটির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। ওই পরিস্থিতি এড়াতে দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন তাঁরা।

দক্ষিণে ৬ দিন ধরে বিক্ষোভ

দক্ষিণ সিটির বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছয় দিন ধরে বিক্ষোভ করছেন। সংস্থার ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে অপসারণের দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। এতে প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের তদারকিতে যাচ্ছেন না।

আশিকুর রহমানকে অপসারণের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার ৩৭৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাক্ষর করে দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তাঁরা অভিযোগ করেছেন, প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বিগত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ও ঊর্ধ্বতন মহলের ছত্রচ্ছায়ায় পদ বাগিয়েছেন। তাঁর অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কারণে সিটি করপোরেশনের উন্নয়নমূলক কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।

চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়, আশিকুরের মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞতা ও কারিগরি দক্ষতা না থাকায় এবং তিনি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত ১২ জুলাই জলাবদ্ধতার কারণে ৪৮ ঘণ্টা নগরবাসী ভোগান্তি পোহান, জনজীবনে দেখা দেয় অচলাবস্থা। এ ছাড়া তাঁর দুর্ব্যবহারের কারণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ ছেড়ে চলে গেছে। ঠিকাদারেরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই তাঁকে অপসারণ না করলে তাঁরা কর্মবিরতিতে যাওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন।

সংস্থাটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এমন প্রতিবাদের মুখে গতকালই অবশ্য স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার আবেদন করেছেন আশিকুর রহমান। ওই আবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। মন্ত্রণালয় থেকে এটি অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আন্দোলনে থাকবেন বলে জানিয়েছেন।

মেয়র ও কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতির ফলে এবং প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা আশিকুর রহমানের অপসারণের দাবিতে চলমান বিক্ষোভ কর্মসূচির কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব কার্যক্রম আদতে বন্ধ হয়ে পড়েছে। যদিও সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দাবি করেছেন, তাঁরা মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতার কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।