নাম তাঁর ফারহান ফাইয়াজ। পুরো নাম মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া। তিনি পৃথিবীতে নেই। তবে তাঁর কথা স্বজন, সহপাঠী, শিক্ষক—সবাই মনে রেখেছেন। আজ বৃহস্পতিবার ছিল ফারহানের জন্মদিন।
ফারহান ফেসবুকে তাঁর অ্যাকাউন্টের বায়োতে লিখেছিলেন, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ তিনি সেটা করতে পেরেছেন।
রাজধানীর রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান গত ১৮ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত হন। তাঁকে মনে রেখেছে সবাই।
ফারহানের জন্মদিনে আজ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তাঁর কলেজের মিলনায়তনে কলেজের পক্ষ থেকে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে ফারহানের বাবা, মা, বোনসহ অন্য স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। মিলাদ শেষে সবাই মিলে কেক কাটেন। ফারহান যে ধরনের একটি দেশের প্রত্যাশায় জীবন দিয়েছেন, তেমন একটি দেশ পাওয়ার প্রত্যাশার কথা জানালেন ফারহানের শিক্ষক ও স্বজনেরাও।
কলেজ মিলনায়তনে মিলাদের আগে ফারহানের বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘অন্যান্য জন্মদিনে ছেলেকে আমরা পাশে পেতাম। বাসায় কেক কেটে পরে সবাই মিলে বাইরে খেতে যেতাম। এই প্রথম তার অনুপস্থিতিতে তাকে আমরা স্মরণ করছি। সন্তান হারানো বাবা–মায়েরাই শুধু এই কষ্ট বুঝতে পারবেন।’
ছেলের সহপাঠীদের নিয়ে দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে চান উল্লেখ করে শহিদুল ইসলাম ছেলের সহপাঠীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বলেন।
কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ বলেন, ফারহানদের মতো সন্তানেরা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ার জন্য নিজেদের জীবন দিয়েছে। ফারহানের সহপাঠীরাও যাতে তাদের বন্ধুর রক্তের দাম দিতে দেশকে ভালোবেসে নিজেদের জীবন দিতে পিছপা না হয়।
মিলাদ শেষে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় ফারহানের স্বজনদের। ফারহানের বাবা শহিদুল ইসলাম একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। তিনি জানালেন, তাঁর একমাত্র ছেলে ফারহানের জন্ম ২০০৭ সালে। মারা যাওয়ার সময় ছেলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ত। ২০২৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। বললেন, ‘ছেলের স্বাস্থ্য ভালো হলেও সে ছিল খুবই নাজুক। বৃষ্টিতে ভিজতে পারত না। একটু বৃষ্টিতেও সে ছাতা নিয়ে বের হতো। সেই ছেলে রাজপথে আন্দোলনে যাবে, তা কল্পনাও করি নাই। ছেলের এক বন্ধু ফোন করে জানায় ফারহান গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সিটি হাসপাতালে গিয়ে ছেলেকে আর পেলাম না, ততক্ষণে সে মারা গেছে।’
ফারহানের বাবা বললেন, ‘এবার ছেলে জন্মদিনের দিন নিজেই গাড়ি চালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে চেয়েছিল। আমি রাজিও হয়েছিলাম। এখন তো ছেলেই নেই। ছেলে হত্যার মামলা করেছি। আশা করছি, ন্যায়বিচার পাব।’
ফারহান গবেষণামূলক কাজ করতে চেয়েছিলেন, দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন বলে জানালেন শহিদুল ইসলাম।
মা ফারহানা দিবা জানালেন, ছেলের জন্মদিনে ছেলের পছন্দের বিরিয়ানি, কাবাব রান্না করে দিতেন। ১৮ জুলাই ছেলে নাশতা করে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। দুপুরের দিকে ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান তিনি। ছেলের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি চাইলেন তিনি।
ফারহানের একমাত্র বোন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়ীমা ইসলাম। সায়ীমা প্রথম আলোকে বলল, তার হাতের ‘ফিশ ফ্রাই’ ভাইয়ের খুব পছন্দের ছিল। এখন এ খাবার আর কার জন্য বানাবে? গত বছর জন্মদিনে কেক কেটে ভাই তাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন, আর এ বছর ভাইকে ছাড়াই ভাইয়ের জন্মদিন। এটা কল্পনাও করেনি উল্লেখ করে সায়ীমা বলে, তার কাছে ভাইয়ের সবকিছুই এখন স্মৃতি।
ফারহান ফাইয়াজের আত্মীয় নাজিয়া খান। ১৮ জুলাই ফারহান গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এ কথা শোনার পর ফারহানের সঙ্গে হাসিখুশি একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ। হি ইজ ডেড নাও। আই ওয়ান্ট জাস্টিস (এই আমার ফারহান ফাইয়াজ। সে এখন মৃত। আমি ন্যায়বিচার চাই)।’
কলেজের মিলাদে উপস্থিত সেন্ট জোসেফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক নাজিয়া খান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ফারহান তাঁর বোনের ননদের ছেলে। তবে পারিবারিকভাবে সম্পর্ক খুব ভালো। তিনি বলেন, ‘একজন আমাকে ফোন করে জানায় ফারহান গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে হাসপাতালে যেতে বলবে। কিন্তু তা না বলে জানাল, ফারহান মারা গেছে। প্রায় দুই মাস হতে চলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ফারহানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।...ফারহান তো জীবনকে খুব ভালোবাসত। আমি আমার বাচ্চার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
ফারহান রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় কলেজের আবাসিক ছাত্র ছিল। নারায়ণগঞ্জে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে ফারহানকে কবর দেওয়া হয়।
আজ মিলাদ শেষেও ফারহানের বন্ধুদের স্মৃতিচারণা শেষ হচ্ছিল না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে একসঙ্গে অংশ নেওয়া ফেরদৌস আহমেদ, মাহীর ইশরাকসহ ফারহানের অন্য বন্ধুরা জানালেন, তাঁরা ফারহানের নামে কলেজের যেকোনো একটি গেটের নামকরণ, লাইব্রেরির নামকরণ এবং কলেজের ভেতরে একটি ফলক করার দাবি জানিয়েছেন।