ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস আমরা জানি, সেটাকে ‘বিকৃত’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসটা কিন্তু বিকৃত। সেটা বদরুদ্দীন উমরের হাত দিয়ে অনেকটা বিকৃত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন ইতিহাস আসলে কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে। কিন্তু আমরা খালি জানি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন।’
বুধবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অমর একুশের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী পর্বে আলোচনায় অংশ নিয়ে মুহাম্মদ সামাদ এসব কথা বলেন।
বুধবার থেকে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়েছে। এতে থাকছে গান, আবৃত্তি, পথনাটক, নাচসহ নানা আয়োজন। জোটের এই আয়োজনের স্লোগান—চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ।
উদ্বোধনী আলোচনায় অংশ নিয়ে মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘১৯৪৭ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এর এক মাস তিন দিনের মাথায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের উদ্যোগে ভাষার দাবিতে হরতাল ডাকা হয়। তারও আগে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক যুবলীগের সম্মেলনে আসেন। ঢাকায় সভা হয়। সেখানে পূর্ববঙ্গের মানুষের লেখাপড়া, আইন-আদালত ও শিক্ষার বাহন হবে বাংলা ভাষা—এ রকম একটা দাবি উত্থাপিত হয়।’
মুহাম্মদ সামাদ আরও বলেন, ‘১১ মার্চের হরতালে বঙ্গবন্ধুসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। আসলে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাজনৈতিক নেতা, যিনি মাতৃভাষার দাবিতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন শুরু হয়, তখন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু অনশনে যাবেন আর ২১ ফেব্রুয়ারি একটা প্রতিবাদ সভা হবে। সেই প্রতিবাদ সভাতেই কিন্তু পুলিশ গুলি চালায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে। সেই ২১ ফেব্রুয়ারি আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বের কথা উল্লেথ করে মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়ে যে ভাষাভিত্তিক সংগ্রামের সূচনা হয়, তারই পথ ধরে আমাদের পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামগুলো হয়। সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ অর্জন করি।’
রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম, এই দেশটা হবে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার সম্প্রীতিময়, সুখী ও আনন্দিত একটা সমাজ। কিন্তু এখন সাম্প্রদায়িকতার কালো থাবা প্রতিদিনই আমাদের গ্রাস করতে চাইছে। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারকে দিয়ে সম্প্রীতিময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অনেক সময় আমরা দেখি না। এই কারণেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট হচ্ছে নিম্নতম। এটা বারবার বলেও উপকার হয় না। বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্প একাডেমি- এগুলো যারা করে, সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ মানুষদের এড়িয়ে আমলাতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে অনেকটা লোক দেখানো অনুষ্ঠানাদি করা হয়। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় একটা পরিবর্তন দরকার। রাজনীতিটাকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার করা দরকার।’
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও লেখক মফিদুল হক বলেন, ‘ভাষার প্রশ্নে বাঙালি জাতি জেগে উঠেছিল। এই মহান সংগ্রামকে আমাদের অনেকভাবে অনুসন্ধান, অনুশীলন ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। কেননা এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকারের সঙ্গে খুব ওতপ্রোতভাবে উচ্চারিত হয় অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন। ভাষা একটা জনগোষ্ঠীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। ভাষার একটা সর্বজনীনতা আছে এবং একইসঙ্গে ভাষা কোনো ধর্মের ভেদাভেদ করে না।’
মফিদুল হক আরও বলেন, ‘১৯৪৭ সালের দেশভাগের মধ্য দিয়ে ধর্মেরভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই রাষ্ট্র ভাষাকেও ধর্মেরভিত্তিতে ভাগ করতে চেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে এই ভাষাকে বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশভাগের পর যখন ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, তখন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে অসাম্প্রদায়িকতাকে রক্ষা করতে হবে, সবরকমভাবে আমাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ওপরে উঠতে হবে এবং মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
এ সময় নতুন পাঠ্যক্রম নিয়েও কথা বলেন মফিদুল হক। তিনি বলেন, আমাদের পাঠ্যক্রমে অনেক রকম পরিবর্তন আনা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে, পাঠদানকে শ্রেশিকক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং আনন্দের সঙ্গে শিক্ষাদানের ধারণাকে যুক্ত করা। তার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চার একটা যুক্ততা তৈরি হয়েছে। ফলে আজকে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বিশাল মাপের জাগরণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। সেখানে কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতি থাকলে এক বিষয়। কিন্তু মিথ্যাচার ও বিকৃত ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে অসত্যকে সামনে এনে পাঠ্যক্রমের ওপর যে আঘাত পরিচালনা করা হচ্ছে, আমরা সবাই মিলে অবশ্যই সেটা রুখে দাঁড়াব। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগসূত্র রচনার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, দেশের শিল্পীসমাজ সেটাকে বাস্তবায়নে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে।
উদ্বোধনী পর্বে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। তিনি জানান, আজ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আর ১৭ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ মঞ্চে অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা আয়োজিত হবে। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে। এতে গান, আবৃত্তি, পথনাটক, নাচসহ নানা আয়োজন থাকবে।
এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জোটের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও অতিথিদের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে অমর একুশের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন শুরু হয়। পরে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পীরা জাতীয় সংগীত ও একুশের গান পরিবেশন করেন। আবৃত্তি করেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা আশরাফুল আলম।
পরে আলোচনা পর্বে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতা আহমেদ গিয়াস, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেজিনা ওয়ালী, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব আখতারুজ্জামান প্রমুখ।