দেশের সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন থাকতে হবে। ইসলামবিরোধী কোনো আইন বা ধারা রাখা যাবে না সংবিধানে। নতুন বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উপেক্ষা করা যাবে না। ‘তরুণ আলেম প্রজন্ম ২০২৪’ ব্যানারে আয়োজিত এক সভায় আলোচকদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যালয়ে ‘সংবিধান সংস্কার: জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা’ শিরোনামে ওই সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় তরুণ আলেমদের কেউ কেউ সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার দাবি জানান। কেউ কেউ বলেন, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখতে হলে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ও পতিত স্বৈরাচার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অকার্যকর করতে চাইছে বলে সভায় উল্লেখ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। তিনি বলেন, ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন পাস করা যাবে না।
সভায় খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সল বলেন, সংবিধানে সরকারপ্রধানকে অসীম ক্ষমতার মালিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বাদ দিতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ না থাকা, ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করার ক্ষমতা—এগুলো সংবিধান থেকে বাদ দিতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই যুগে অচল ধারণা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় আলেমদের উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল। তিনি বলেন, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলেমদের দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। আলেমরা শুধু আলেমদের নেতৃত্ব দেবেন, বিষয়টি এমন নয়। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আলেমরা জাতীয় নেতৃত্ব ও জাতি গঠনের জায়গায় চলে এসেছেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ‘তরুণ আলেম প্রজন্ম ২০২৪’–এর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা এহসানুল হক। তিনি বলেন, তাঁরা এমন সংবিধান চান, যেখানে চাপিয়ে দেওয়া চার মূলনীতি থাকবে না, যেখানে ফ্যাসিবাদ তৈরির পথ স্থায়ীভাবে রুদ্ধ করে দেওয়া হবে এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন থাকবে না।
সভার শুরুতে বক্তব্য দেন তরুণ আলেম প্রজন্ম ২০২৪-এর নির্বাহী পরিষদের সদস্য বেলাল আহমেদ চৌধুরী, শেখ সাব্বির আহমদ, সানাউল্লাহ খান, মাবরুরুল হক ও আহসান আহমদ খান। তাঁদের বক্তব্যে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনরায় যুক্ত করা, সংবিধানে মুসলমানদের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন রাখার বিষয়টি ছিল।
ওই চারজনের মধ্যে মাবরুরুল হক বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে রাখা হলে এর সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা উল্লেখ থাকতে হবে। আহসান আহমদ খান বলেন, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিতে হবে। এই ‘সুসময়ে’ চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের দাবিগুলো আদায় করতে না পারলে আবার পিছিয়ে পড়তে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সভায় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সভাপতি শেখ ফজলুল করীম মারুফ বলেন, ‘জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দর্শনটাই ধর্মনিরপেক্ষ। সংবিধানটা দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ সবার জন্য। আমরা যদি ৯২ শতাংশ মুসলমানের পরিচয়টা বাংলাদেশি পরিচয়ের ওপর বড় করে তুলি, তখন ৮ ভাগ হিন্দুর দেশ—ওই বিষয়টাও বড় হয়ে ওঠে। সুতরাং সংবিধানসংক্রান্ত পর্যালোচনায় আমরা ধর্মনিরপেক্ষবাদকে টার্গেট না করি।...আমাদের সংবিধানে সব ধর্মের সমান অধিকার, সব ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা, কোনো ধর্মকে বাধা না দেওয়া—এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতায় আমরাও বিশ্বাস করি।’
শেখ ফজলুল করীম মারুফের বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্রই সামনের সারিতে বসা এক তরুণ আলেম বলে ওঠেন, ‘মুসলমান তো ধর্মনিরপেক্ষ হইতেই পারে না’। এ সময় মঞ্চে বসা অন্য আলেমরা হাত দিয়ে ইশারা করলে তিনি থেমে যান।
সভায় মুখ্য আলোচক ও সমাপনী বক্তা ছিলেন লেখক মাওলানা মুসা আল হাফিজ। তিনি বলেন, এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা সহিশুদ্ধভাবে পাঁচটা সুরা বলতে পারবেন কি না, সন্দেহ আছে। সেই ব্যক্তি বলে দিচ্ছেন, একজন মানুষ মুসলমান হলে সেক্যুলার হতে পারেন না, সেক্যুলার হলে মুসলমান হতে পারেন না। ব্যাপারটা কি এত সহজ? তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সেক্যুলার দল। তাহলে সব তো কাফির হয়ে গেল! এত সহজ! আপনি বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মুসলমানকে কাফের বানিয়ে দিচ্ছেন এক ফতোয়া দিয়ে। আপনি কে?’
সবকিছুকে এত সরলীকরণ না করার আহ্বান জানান মুসা আল হাফিজ। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উপেক্ষিত রাখা যাবে না। হোক সেটা পাঠ্যপুস্তক বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যেকোনো স্তরে। সংবিধানে প্রজাতন্ত্র কথাটা গ্রহণযোগ্য নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে গুলিস্তানের পীর ইয়ামেনী জামে মসজিদের খতিব ইমরানুল বারী সিরাজী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী সদস্য মেহেরাব হোসেন সিফাত, রফিকুল ইসলাম আইনীসহ আরও অনেকে বক্তব্য দেন।