আগুনে মেয়ে ও নাতিদের হারিয়েছেন বাসনা রানী (মাঝখানে)। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে তাঁর আহাজারি থামছে না।
আগুনে মেয়ে ও নাতিদের হারিয়েছেন বাসনা রানী (মাঝখানে)। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে তাঁর আহাজারি থামছে না।

বেইলি রোডে আগুন

সন্তানদের নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন মা, মর্গে হলো তাঁদের ঠিকানা

‘কোথায় গেলি ও সম্পূর্ণা, ও সান, ও পপি...। এ কী হয়ে গেল আমাদের? আগুনে একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল?’। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গের সামনে এভাবেই চিৎকার করছিলেন পীযূষ পোদ্দার। বেইলি রোডের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তাঁর বোন পপি, ভাগনে সান রায় (১০) ও ভাগনি সম্পূর্ণা রায় (১২)।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মর্গের সামনে কথা হয় পীযূষ পোদ্দারের সঙ্গে। তিনি জানান, ভাগনি সম্পূর্ণা পড়ত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর সান রায় পড়ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে। মা–বাবার সঙ্গে মালিবাগে থাকত তারা।

সম্পূর্ণা ও সান

সম্পূর্ণা ও সানকে বৃহস্পতিবার স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন মামা পীযূষ পোদ্দার। স্কুল শেষে আবার বিকেলে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন তিনি। সম্পূর্ণা ও সান মা পপি রায়ের সঙ্গে সন্ধ্যার সময় আসে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয়।

পীযূষ পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে চলে যান। এসে দেখেন দাউ দাউ করে রেস্তোরাঁ জ্বলছে। কিন্তু কোথাও পপি, সম্পূর্ণ ও সানের খোঁজ পাননি। এরপর মধ্যরাতে ছুটে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। সম্পূর্ণা ও সানের মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু পপির কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।

বেইলি রোডের বহুতল ভবনের আগুনে সম্পূর্ণা, সানের মতো ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার রাত একটার পর একে একে বেইলি রোড থেকে লাশের সারি আসতে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। খবর পেয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ছুটে আসেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা।

একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন মেহেরান কবির (দোলা)। তাঁর বোন মায়েশা কবির পড়তেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বোন মিলে মতিঝিলে থাকতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে মতিঝিল থেকে তাঁরা বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে আসেন। আগুনে পুড়ে এই দুই বোনও মারা গেছেন। তাঁদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের বাতাস।

আগুনে পুরো পরিবার শেষ

দুই সন্তান আয়ান (৮) ও আয়াতকে (৬) নিয়ে বেইলি রোড এলাকায় বসবাস করতেন নাজিয়া আক্তার (৩১)। তাঁর স্বামী মো. আশিক পেশায় ব্যবসায়ী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্যবসার কাজে বনানীতে যান। নাজিয়া দুই সন্তানকে নিয়ে ভবনের তৃতীয় তলার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে যান। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বামীকে ফোন দিয়ে বলেন তাঁরা বিপদে আছেন।

স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে নাজিয়া আক্তার। এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি

প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছেন নাজিয়ার আত্মীয় রিফাত হোসেন। তিনি ঘটনার সময় ওই ভবনের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ভবনটির নিচতলায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পান। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তৃতীয় সিঁড়ি থেকে আয়ানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগুনে মারা গেছেন নাজিয়া এবং আয়াতও। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে তাঁদের মরদেহ রাখা হয়েছে।

মধ্যরাত থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে স্বজনহারাদের ভিড়। তাঁদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাতাস। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার এতটুকু ভাষাও যেন জানা নেই কারও।