শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য বিক্রির পাশাপাশি চলছে বিজ্ঞাপনও।
রাজধানীর ফার্মগেটে গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের ফটকের ঠিক সামনে বাঁ দিকে একটি চায়ের দোকান। পরিত্যক্ত ব্যানারের ছাউনি আর টিন দিয়ে ঘেরা দোকানটি। সেখানে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন পাশে রাখা বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছেন আর সিগারেট টানছেন। দোকানির কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চান, একেবারে বিদ্যালয়ের সামনে এভাবে সিগারেট বিক্রি করতে কেউ কোনো দিন বাধা দেয়নি? মুচকি হেসে দোকানি বলেন, ‘বাধা দিব কেডা? এহেনে সমস্যা কোনহানে?’
শুধু এই অস্থায়ী চায়ের দোকানেই নয়, বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো দিকে যে বড় মুদিদোকান আছে, সেখানেও সিগারেট বিক্রি করা হয়।
স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের নির্দেশিকা অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত পণ্যের বিক্রি নিষিদ্ধ। অথচ নগরীর এই বিদ্যালয়ের গা-ঘেঁষেই অবাধে চলছে সিগারেট বিক্রি।
সিগারেট কোম্পানিগুলো শিশু-কিশোরদের আগামী দিনের ভোক্তা বিবেচনা করে আর তাদের ভোক্তা হিসেবে পেতেই নানা প্রচারণা চালায়।সৈয়দ মাহবুবুল আলম, জনস্বাস্থ্য আইন ও তামাক নিয়ন্ত্রণবিশেষজ্ঞ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের বিক্রির পাশাপাশি বিজ্ঞাপনও দেখানো হচ্ছে। এসব দেখার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর। তবে এদিকে কারও নজর নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তির ব্যবহারে তামাক আইন বাস্তবায়ন এবং তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন কমানো সম্ভব। কিন্তু বড় পরিসরে এর কোনো প্রয়োগ নেই।
এমন পরিস্থিতি আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বন্ধ করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’
বিদ্যালয়ের আশপাশের নির্দিষ্ট এলাকায় তামাক বিক্রি বন্ধে সিটি করপোরেশন এখনো সেই অর্থে কোনো চেষ্টা করেনি। তবে এ কাজ দ্রুত শুরু করার কথা ভাবছি। জুন মাসে একাধিক অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা আছেডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী
শিশুদের তামাক গ্রহণের চিত্র
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের গ্লোবাল অ্যাডাল্টস টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধূমপায়ী বা তামাক সেবনকারীদের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। আর টোব্যাকো অ্যাটলাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০-১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৬ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য আইন ও তামাক নিয়ন্ত্রণবিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহবুবুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সিগারেট কোম্পানিগুলো শিশু-কিশোরদের আগামী দিনের ভোক্তা বিবেচনা করে আর তাদের ভোক্তা হিসেবে পেতেই নানা প্রচারণা চালায়। তাই তামাকের ব্যবহার কমছে না।
২০১৬ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মোট ১১০টি বিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা চালায়। এতে বিদ্যালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যে থাকা মোট ৫০৭টি মুদিদোকানের ৪৮৭টিতেই অন্য পণ্যের পাশাপাশি তামাকদ্রব্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
আমাদের সরকারি কাজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ সহযোগিতা খুবই সহায়ক হয়েছে। অন্যত্রও এটি প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে।ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুজা মন্ডল
বিদ্যালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক বিক্রি বন্ধ করতে নজরদারির দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর। যেমন ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বা তাঁর কার্যালয়ের কর্মীরা এ কাজ করতে পারেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান সেই দায়িত্ব পালন করছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের আশপাশের নির্দিষ্ট এলাকায় তামাক বিক্রি বন্ধে সিটি করপোরেশন এখনো সেই অর্থে কোনো চেষ্টা করেনি। তবে এ কাজ দ্রুত শুরু করার কথা ভাবছি। জুন মাসে একাধিক অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা আছে।’
প্রযুক্তির প্রয়োগে কমে তামাকের বিজ্ঞাপন
জনপরিসরে তামাকজাত পণ্য বা ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও এটা প্রায় কেউ মানে না। আবার তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ হলেও তা থেমে থাকছে না। এ অবস্থায় বরিশালভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ‘গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি’ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন কমিয়ে আনতে পেরেছে। সংগঠনটির তৎপরতায় এই বিভাগে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সিগারেটের বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন ২ শতাংশের বেশি, গুলের ৭০ শতাংশ আর বিড়ির ৪ শতাংশ কমেছে।
সংগঠনটি ২০১৯ সালে বরিশাল বিভাগের ১২টি পৌরসভার ৬ হাজার ৮২২টি দোকান জরিপ করে একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করে। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে দোকানগুলোর তামাকজাত পণ্য বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শনের চিত্র ধারণ করা হয়। এগুলোর জিপিএসের লোকেশনও শনাক্ত করা হয়।
পরে এসব দোকানে তামাকজাত পণ্যের অবৈধ প্রদর্শনের চিত্র সংগঠনটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌর মেয়র, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনকে জানায়। এ ছাড়া দোকানিদের সচেতন করতে কাজ করে তারা।
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম না মেনে যেসব দোকানে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হতো, তা কখনো কখনো আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে জানাতেন সংগঠনের কর্মীরা। পরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করে।
এভাবে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে একাধিক অভিযান পরিচালনা এবং তামাকের অবৈধ বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুজা মন্ডল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সরকারি কাজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ সহযোগিতা খুবই সহায়ক হয়েছে। অন্যত্রও এটি প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে।’