ঢাকা উত্তর সিটি

টাকার বিনিময়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বর্জ্যের গাড়ির চাবি দেওয়ার অভিযোগ

অন্তত দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের (ট্রাক ক্লিনার) হাতে বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি দেওয়ার অভিযোগ।

উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি
ছবি: সংগৃহীত

টাকার বিনিময়ে বর্জ্য পরিবহনের ভারী গাড়ির চাবি তুলে দেওয়া হচ্ছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের (ট্রাক ক্লিনার) হাতে। আর ভারী যান চালানোয় দক্ষ চালকদের দেওয়া হচ্ছে অন্য দায়িত্ব। এমন অনিয়মের অভিযোগ ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) পরিবহন বিভাগের দুজন কর্মকর্তা ও দুজন কর্মীর বিরুদ্ধে।

এর মূলে পরিবহনের সমন্বয়ক মহসীন রেজা। তাঁকে প্রশ্রয় দেন পরিবহনের ব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আরাফাত হোসেন। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে টাকা লেনদেন করেন দুজন কর্মী নাছির খান ও মো. সাজ্জাদ। এর মধ্যে মহসীনের বিরুদ্ধে গত অক্টোবরে মেয়র বরাবর একটি অভিযোগ দেন চালকেরা। কিন্তু সে বিষয়ে তদন্ত এগোয়নি।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী হয়েও বর্জ্য পরিবহনের ভারী গাড়ি চালানো ১৭ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ ছাড়া স্থায়ী ও মাস্টাররোলের চারজন চালকের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা জানান, চালক–সংকটের সুযোগে টাকা নিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে গাড়ি দেওয়া হচ্ছে। এতে বেতনের পাশাপাশি বেঁচে যাওয়া জ্বালানি বিক্রি করে উপরি আয় হয়। পাশাপাশি গাড়ি চালালে বর্জ্যের কাজ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

চালকসংকট নিয়েই শহরটাকে পরিষ্কার রাখতে হচ্ছে। তবে এ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে, টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেলে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া চালকদের অনিয়ম বন্ধে পরীক্ষামূলকভাবে বর্জ্যের ১০টি গাড়িতে ‘ড্যাশ ক্যামেরা’ স্থাপন করা হয়েছে।
আতিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র

৪৭ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর হাতে গাড়ি

ঢাকা উত্তর সিটিতে বর্জ্য পরিবহনের ৪৫টি কনটেইনার ক্যারিয়ার, ৫৩টি কম্পেক্টর এবং ৪৩টি খোলা ট্রাক মিলিয়ে ১৪১টি গাড়ি সচল আছে। বিপরীতে ভারী যান চালানোর লাইসেন্সধারী চালক আছেন ১১২ জন। এর মধ্যে করপোরেশনের নিজস্ব চালক (স্থায়ী পুরোনো) ৬১ জন, স্থায়ী নতুন ৩২ জন এবং মাস্টাররোলের ১৯ জন। পুরোনো ভারী চালকদের মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত ও দুর্ঘটনার কারণে ৬ জন চালকের হাতে গাড়ি নেই।

স্থায়ীভাবে নতুন নিযুক্ত ৩২ জন চালকের মধ্যে বর্জ্যের গাড়িতে আছেন মাত্র ৫ জন। কর্মকর্তাদের হালকা গাড়ি চালাতে দেওয়া হয়েছে ৭ জনকে। আর নতুন ১৫ চালককে পদায়ন করা হয়েছে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে। বাকি ৫ জন আছেন যান্ত্রিক শাখায়। পাশাপাশি মাস্টাররোলের ১৯ জন ভারী যানের লাইসেন্সধারী চালকেরা বর্জ্যের গাড়ি চালাচ্ছেন।

যে ১৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১১ জন নির্দিষ্ট করে টাকার পরিমাণ বলেছেন, যা ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। টাকাগুলো কেউ জ্বালানি স্লিপ প্রদানকারী কর্মী নাছির খান ও মো. সাজ্জাদের মাধ্যমে, কেউ আবার সরাসরি মহসীন রেজার হাতে দিয়েছেন বলে জানান।

সব মিলিয়ে ১৪১টি ভারী গাড়ির বিপরীতে চালক আছে মাত্র ৭৯ জন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাকি ৬২টি বর্জ্যের গাড়ির মধ্যে প্রায় ৪৭টি গাড়ি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে। কিছু গাড়ি পরিবহন ও বর্জ্য বিভাগে দক্ষ শ্রমিকেরা (চালক) চালাচ্ছেন।

গাড়িপ্রতি ৪০-৬০ হাজার

যে ১৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১১ জন নির্দিষ্ট করে টাকার পরিমাণ বলেছেন, যা ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। টাকাগুলো কেউ জ্বালানি স্লিপ প্রদানকারী কর্মী নাছির খান ও মো. সাজ্জাদের মাধ্যমে, কেউ আবার সরাসরি মহসীন রেজার হাতে দিয়েছেন বলে জানান।

অন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা টাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও পরিমাণ উল্লেখ করেননি। শুধু বলেছেন, কর্মকর্তাদের খুশি করতে ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। চাকরির ঝুঁকির কারণে সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাঁদের নাম ও পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেন।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ওয়ার্ডে কম্পেক্টর গাড়ি চালানো একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, তিনি নাছির খানের মাধ্যমে পরিবহন তত্ত্বাবধায়ক মহসীনকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তাঁকে ৫০ হাজার দিতে বলেছিল। টাকা দিতে না পারায় কয়েক মাস তিনি গাড়ি ছাড়া ছিলেন। আরও কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী গাড়ি পাওয়ার জন্য নগরভবন ও গাবতলীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পেছনে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ করার কথা স্বীকার করেন।

গাড়িটা নিতে অপু নামের একজন চালকের মাধ্যমে মহসীন স্যাররে ৮০ হাজার টাকা দিছি। টুকটাক মিষ্টি খাওয়াইতে খরচা হইসিল আরও ২০ হাজার টাকা
মোজাফ্ফর নামের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী

বেতনের সঙ্গে উপরি কামাই

খ্যাপ (ট্রিপ) ও দূরত্বের ভিত্তিতে বর্জ্যের গাড়ি চালালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী চালকদের উপরি কিছু আয় হয়। তাঁরা বলছেন, জ্বালানি বিক্রি করে সপ্তাহে তাঁদের ৪-৫ হাজার টাকা থাকে। এই টাকা কেউ পাম্প থেকে নেন, কেউ আবার বাইরে তেল বিক্রি করেন।

অঞ্চল-৫ এর কাজ শেষে প্রায়ই অঞ্চল-৩ এর দুটি এলাকায় বাড়তি দুটি খ্যাপ দেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী চালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি খ্যাপে তাঁকে ১৩ লিটার করে জ্বালানি দেওয়া হয়। সেখান থেকে সপ্তাহে তাঁর প্রায় ৫ হাজার টাকা থাকে।

রয়েছে প্রাণহানির ঘটনা

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। ওই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেল খান।

এর এক দিন পরেই পান্থপথে ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হন প্রথম আলোর সাবেক কর্মী আহসান কবীর খান। ১০ চাকার ওই ডাম্প ট্রাকটি ছিল উত্তর সিটির। সেটি চালাচ্ছিলেন মো. হানিফ নামে বহিরাগত একজন চালক।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত ময়লার ভারী গাড়ি চালনায় অদক্ষ হওয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।

চালকসংকট নিয়েই শহরটাকে পরিষ্কার রাখতে হচ্ছে। তবে এ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে, টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেলে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম

দুর্ঘটনা ছাড়াও অদক্ষ চালকের হাতে উচ্চ মূল্যের এসব গাড়ি তুলে দেওয়ায় তা দ্রুত নষ্ট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি চেসিস ভেঙে ফেলায় মোজাফ্ফর নামের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী চালকের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে মোজাফ্ফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়িটা নিতে অপু নামের একজন চালকের মাধ্যমে মহসীন স্যাররে ৮০ হাজার টাকা দিছি। টুকটাক মিষ্টি খাওয়াইতে খরচা হইসিল আরও ২০ হাজার টাকা।’

তাঁদের অস্বীকার

টাকার বিনিময়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়ার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেন মহসীন রেজা। তিনি বলেন, অনেক চালক বাড়িতে থেকে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালান। তিনি বরং চালকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে দাবি করেন। যে কারণে চালকেরা তাঁর পিছু লেগেছে।

উত্তর সিটির সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন। অতিরিক্ত হিসেবে তিনি পরিবহনের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ড্রাইভাররা গাড়ি পরিষ্কার করে রাখে না, বদলি চালক দিয়ে গাড়ি চালায়—এগুলোতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। এটাই হয়তো কারণ হতে পারে।’

মেয়র বললেন

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চালকসংকট নিয়েই শহরটাকে পরিষ্কার রাখতে হচ্ছে। তবে এ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে, টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেলে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া চালকদের অনিয়ম বন্ধে পরীক্ষামূলকভাবে বর্জ্যের ১০টি গাড়িতে ‘ড্যাশ ক্যামেরা’ স্থাপন করা হয়েছে।