জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান বলেছেন, তথ্যপ্রাপ্তি ও বাক্স্বাধীনতা ছাড়া উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি গণতন্ত্রও টিকে থাকতে পারে না। মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও এ দুটি অভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আজ বুধবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পর্যটন করপোরেশন মিলনায়তনে ‘তথ্য অধিকারের মাধ্যমে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার অগ্রগতি সাধন’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইরিন খান এসব কথা বলেন।
সেমিনারটির আয়োজন করে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ (আরআইবি)। সংগঠনটি তথ্য অধিকার আইনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক বছর দুই মাসব্যাপী দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠপর্যায়ে গবেষণা করা হয়েছে। এ গবেষণার ফলাফল নিয়ে সেমিনারটি আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইরিন খান বলেন, জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার, লিঙ্গসমতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও পরিবেশগত বিষয়গুলোর অগ্রগতির ক্ষেত্রে তথ্যপ্রাপ্তি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইন জনগণকে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার দিলেও সরকার তা টেনে ধরে রাখে। ব্যক্তিগত বা দাপ্তরিক গোপনীয়তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা—এমন অনেক কারণ দেখিয়ে জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। তথ্য অধিকার আইনের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুরক্ষা আইন করা হয়। এসব আইন ও বিধিবিধানে ‘গোপনীয়তা’ ও ‘সুরক্ষা’কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতে জনসাধারণ তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
আইরিন খান আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হওয়ায় সংস্কারের একটি নতুন পর্যায় সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তথ্য অধিকার আইনটিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্য কমিশন প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা সফল হলেও এখন কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ আমলা–নিয়ন্ত্রিত। দুঃখজনকভাবে দলীয় লোকজন ও ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা হচ্ছে। যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতিতে তথ্য ধরে রাখার প্রবণতা রয়েছে। এটিই জনসাধারণের তথ্যপ্রাপ্তির বড় অন্তরায়। তথ্য কমিশনের কর্মকর্তাসহ সরকারি সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের আচরণগত পরিবর্তন করা যাবে না।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, আরআইবিসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথ্য অধিকার চর্চা নিয়ে কাজ করছে। জনসাধারণকে বিষয়টি অবগত করা, তথ্য পাওয়ার অধিকার ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানোর মতো কাজ করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন চাপের মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। তবে আইনটিকে দুর্বল করতে ৭ নম্বর ধারাসহ যেসব ধারা যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো মূল আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব ধারা পরিবর্তন করে আইনটিকে আরও কার্যকর করতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়েন আরআইবির প্রকল্প ব্যবস্থাপক রুহি নাজ। তিনি জানান, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নীলফামারী, দিনাজপুর, মৌলভীবাজারের ছয়টি উপজেলায় তথ্য অধিকার নিয়ে গবেষণা করা হয়। এ সময় তথ্য অধিকার আইনে ১ হাজার ৫৯১টি আবেদন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৮৯৩টি আবেদনে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় ২ হাজার ৬০০ মানুষ এই গবেষণায় অংশ নেন।
প্রবন্ধে তথ্য অধিকার আইনের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের আইনটির প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া এবং কমিশনকে জনবান্ধব করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মূল বক্তব্যের ওপর আলোচনা করেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন এবং গবেষক ও অধিকারকর্মী রেজাউর রহমান।
সেমিনারে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন আরআইবির নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৯ সালে ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ পাস হয়েছিল। এই আইনে দেশের সব নাগরিক তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে সরকারি কাজে তদারকির অধিকার অর্জন করে। আইনটি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। আরআইবি এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ব্লাস্টের আইনজীবী মাহবুবা আক্তার, উত্তরবঙ্গের তথ্য অধিকারকর্মী সামিউল আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নিশিতা জামান ও শিল্পী দিবারাহ মাহবুব।