হাসপাতালের বিছানায় তিন বছরের সন্তান ইব্রাহিমকে নিয়ে বিষণ্ন মনে বসে ছিলেন মা রুবি বেগম। তাঁর এমন উদ্বেগের কারণ হাসপাতালে ভর্তির পর সন্তানের রক্তে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা বুধবার অস্বাভাবিক হারে কমে গিয়েছিল। আট বছর বয়সের বড় ছেলেকে বাসায় রেখে ছোট ছেলেকে নিয়ে সাত দিন ধরে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্তানের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও কবে ঘরে ফিরতে পারবেন, তা নিশ্চিত নন তিনি।
রুবি বেগমের সন্তানের মতো আরও ৮১ জন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতাল চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে ছয় মাসের শিশুও রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভর্তি রোগীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই শিশু। প্রতিনিয়তই শিশুদের নিয়ে অভিভাবকেরা হাসপাতালে আসছেন। অর্ধেকের মতো শিশুকে তাঁরা ভর্তি করছেন।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপর শিশুদের নিয়ে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে এসে ভিড় করছেন অভিভাবকেরা। সিট খালি না থাকায় মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা শুরু করতে তোড়জোড় করছেন তাঁরা। শিশু ওয়ার্ডসহ এই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে ডেঙ্গু ইউনিটের ভেতর হাঁটাচলা করাই কঠিন। কর্তৃপক্ষ বলছে, বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে আরও দুটি ফ্লোর তৈরি করে রেখেছেন তাঁরা।
মুগদা হাসপাতালের তৃতীয়, নবম ও দশম তলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। গতকাল পর্যন্ত এই তিনটি ফ্লোরে ৩৫৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ৮১ জন শিশু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত) আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৪। চলতি জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ২ হাজার ১২৯ ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আছেন ১ হাজার ৪৯০ জন। এ ছাড়া চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ১১৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা যান গত বছর—২৮১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৭ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা গেছেন।
গতকাল বিকেলে শিশু ইব্রাহিমের মা রুবী বেগমের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ঈদের আগে তাঁদের প্রতিবেশী এক নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই দুই সন্তানের একসঙ্গে জ্বর হওয়ার কারণে তাঁদের সন্দেহ হয়। সন্দেহ থেকেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। পরে ছোট ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়লে দ্রুত মুগদা হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি আছেন। প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ছে। গত জুন মাসে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ হাজার ৮৯১ জন। চলতি মাসের প্রথম ছয় দিনেই ভর্তি হয়েছেন ৫৮৮ জন।
মুগদা হাসপাতালের দশম তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে গতকাল ১৫৮ জন ভর্তি ছিলেন। এসব রোগীর জন্য সেখানে নার্স রয়েছেন মাত্র ১২ জন। এঁরা চারজন করে তিন পালায় কাজ করেন। দায়িত্বরত দুজন নার্স প্রথম আলোকে বলেন, দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় পাচ্ছি না। রোগীর চাপে তাঁরাও কাহিল। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে তিনজন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ২০ জন মেডিকেল অফিসার ও ৫০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স চেয়ে তাঁরা স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে গত ২১ জুন চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তাঁরা কোনো জনবল পাননি।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক প্রবাহ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ১০ জন রোগীর মধ্যে তাঁরা ২ জন ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছেন। যাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। জ্বরের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের অনেকেই ডায়রিয়া ও পেটব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন।
গতকাল সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ছয়তলায় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা পুরুষ ইউনিটের ১৪টি শয্যার সব কটিতেই রোগী ভর্তি করা হয়েছে। এসব রোগীর বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। পাশেই নারী ওয়ার্ডে আটটি শয্যার মধ্যে পাঁচটিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন।
তা ছাড়া এই দুই ওয়ার্ডে যাঁদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না, তাঁদের একই তলায় মেডিসিন ইউনিট ৫-এ ভর্তি করানো হচ্ছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই ইউনিটে সাতজন ভর্তি হয়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রাজধানীর মহাখালীতে ডিএনসিসি (ঢাকা উত্তর সিটি) কোভিড হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে সেখানে এই হাসপাতাল চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে সেখানে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫ জন রোগী ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দুপুর ১২টার দিকে সেখানে কর্তব্যরত নার্সদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক যখন কথা বলছিলেন, তখন আরও দুজন রোগী আসেন ভর্তি হতে।
ওই হাসপাতালেই ভর্তি থাকা দেবাশীষ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আটজন আনসার সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। তিনিও তাঁদের একজন।
রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন অবনতির পেছনে সিটি করপোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করছেন যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের বাসিন্দা মো. মিরাজ। পবিত্র ঈদুল আজহার পরদিন শুক্রবার জ্বর এসেছিল তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ জুনায়েদের। চার বছরের জুনায়েদকে নিয়ে সোমবার থেকে মুগদা হাসপাতালে রয়েছেন তিনি। মিরাজের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন ঠিকমতো ওষুধ ছিটালে তাঁর সন্তান হয়তো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতো না।