ক্ষুধা মোকাবিলায় বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও এখানে এখনো মাঝারি মাত্রার ক্ষুধা বিরাজ করছে। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্কোর ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
আজ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২৪-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯ দশমিক ৪ স্কোর পেয়ে বাংলাদেশ ১২৭টি দেশের মধ্যে ৮৪তম অবস্থানে রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধা বিরাজ করছে।
রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশ এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের যৌথ আয়োজনে ‘ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের পথে: বাধা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে। ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশ এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিলেই এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪-এর তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষুধা নিরসনে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও এখনো জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২-এর প্রকৃত ক্ষুধামুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে অনেক দূরে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষ খাবারের তীব্র সংকটে থাকে।
এ বছরের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ৪। এটা মাঝারি মাত্রার ক্ষুধার নির্দেশক। ২০১৬ সালের তুলনায় ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঘটলেও এ স্কোর অপুষ্টিসহ সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা নির্দেশ করে।
মূলত চারটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ক্ষুধা সূচকের স্কোর নির্ধারিত হয়েছে: এর মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার । বাংলাদেশে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ খর্বকায়। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের ১১ শতাংশ শারীরিকভাবে দুর্বল। পাঁচ বছর বয়সের আগে প্রায় ৩ শতাংশ শিশু মারা যায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে জেন্ডার ন্যায্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি অর্জন করতে হলে ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আইনি অধিকার, আনুষ্ঠানিক শর্তাবলি এবং অনানুষ্ঠানিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, যা প্রায়ই পরিবার ও সমাজে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।
আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘অনিরাপদ কৃষি চর্চার ফলে আমরা নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে পারছি না। এতে পুষ্টিনিরাপত্তাও নিশ্চিত হচ্ছে না।’ মাছসহ বাংলাদেশে যে ধরনের প্রাকৃতিক খাদ্য বৈচিত্র্য আছে, তা রক্ষার ওপর জোর দেন তিনি। এ ছাড়া খাদ্যনিরাপত্তায় নারীর লোকজ জ্ঞানকেও গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি। এ ছাড়া অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও খাদ্যব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেশন মিশেল ক্রেজা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বহু খাতভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রমে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়ে আসছে। দরিদ্র মানুষ অনেক সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না। তাই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দরিদ্রসহ অন্যান্য বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে আরো অগ্রাধিকার দিয়ে সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তার ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পঙ্কজ কুমার বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্ষুধা হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে; কিন্তু ২০২৪ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখনো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ক্ষুধার চক্রকে ভাঙতে আমরা কমিউনিটিভিত্তিক সমাধান, অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা এবং জলবায়ু সহনশীলতার শক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন সরকারের নীতিনির্ধারক, বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন অংশীদার, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ এবং উন্নয়নকর্মীরা। তাঁরা ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের কার্যকর সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন।
সমাপনী বক্তৃতায় কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনিষ কুমার আগরওয়াল বলেন, এবারের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স প্রতিবেদন কেবলমাত্র ক্ষুধার প্রবণতা ও দেশের স্কোর নিয়েই মূল্যায়ন করেনি বরং জলবায়ু সহনশীলতা ও শূন্য ক্ষুধার জন্য জেন্ডার বৈষম্য মোকাবিলার গুরুত্ব নিয়েও গভীর বিশ্লেষণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির কারণে সাধারণত নারী ও কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা আবহাওয়ার চরম অবস্থা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবেও বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। জেন্ডার নিরপেক্ষতাকে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আজকের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃব্য দেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদুল হাসান, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ হাসান এবং বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
২০২৪ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৭৫তম বার্ষিকী এবং খাদ্য অধিকার নির্দেশিকার ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ল অব পিস অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের সহলেখকরা আরও কার্যকর এবং সংগত নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।