দক্ষিণ সিটির জন্মসনদ নিয়ে পাসপোর্টসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে জটিলতা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নিজস্ব সার্ভার দিয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সেবা দিচ্ছে। গত সোমবার দুপুরে ডিএসসিসির অঞ্চল ২-এর কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নিজস্ব সার্ভারে এখন সহজেই জন্মনিবন্ধন করা যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে দেখা দিয়েছে আইনিসহ অন্যান্য জটিলতা।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য যাচাইয়ে আন্তযোগাযোগের জন্য ডিএসসিসির সঙ্গে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নেই। এ অবস্থায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা পাওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে আবেদন করে দ্রুত জন্মসনদ পাওয়া একাধিক ব্যক্তি পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলে জানা গেছে।

ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধনের বিষয়টি আইনবিধির লঙ্ঘন উল্লেখ করে ইতিমধ্যে আপত্তি জানিয়েছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন।

১৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে এ নিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) মো. রাশেদুল হাসান।

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদুল হাসান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কাজের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের। তাই ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে এসংক্রান্ত কোনো কাজ করা আইন ও বিধির লঙ্ঘন।’

চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ৭ (ক) (২) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারা তুলে ধরা হয়েছে।

আইনের ৭ (ক) (২) ধারায় বলা আছে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব ও কার্যাবলি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। আর বিধিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারায় উল্লেখ আছে, সফটওয়্যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সক্ষমতা না থাকায় নিবন্ধন নিয়ে জনভোগান্তি দেখা দিয়েছিল। জনভোগান্তির কথা চিন্তা করেই ডিএসসিসি নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধনের কাজ শুরু করেছে। পাসপোর্ট-সংক্রান্ত যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা সমাধানে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ সই করা হবে।

নিবন্ধন হচ্ছে সহজে, তবে...

রাজস্বের অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ডিএসএসসিতে তিন মাস জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। নিজস্ব সার্ভার তৈরি করে ৪ অক্টোবর ডিএসসিসি এই সেবা চালু করে। স্বতন্ত্র সার্ভার চালু হওয়ায় নিবন্ধন ফির অর্থ সরাসরি পাচ্ছে ডিএসসিসি।

এখন ডিএসসিসির আওতাভুক্ত এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা সংস্থার নিজস্ব জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভারে গিয়ে সহজে আবেদন করতে পারছেন।

তবে কেন্দ্রীয়ভাবে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা সার্ভারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর সঙ্গে ডিএসএসসির নিজস্ব সার্ভারের আন্তসংযোগ নেই। ফলে ডিএসসিসির সার্ভারে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে জমা হচ্ছে না।

গত সোমবার দুপুরের দিকে ডিএসসিসির অঞ্চল ২ (খিলগাঁও)-এর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নিবন্ধনের বুথের সামনে লোকজনের ভিড়।

দক্ষিণ মাদারটেক এলাকার বাসিন্দা কাউসার আহমেদ এই কার্যালয়ে এসেছিলেন তাঁর ৬ বছর বয়সী ছেলের জন্মনিবন্ধনের আবেদন জমা দিতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সহজেই আবেদন করতে পেরেছেন।

নাজমা ইসলাম নামে এক নারী বলেন, ছেলের জন্মনিবন্ধনে তাঁর (নাজমা) নিজের নাম সংশোধনের আবেদন জমা দিতে এসেছেন তিনি। একই সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের একটি আবেদনও জমা দেবেন তিনি। তাঁর ভাইয়ের পুরোনো (অনলাইনভুক্ত নয়) জন্মসনদে জন্মসাল ভুল আছে। এখন তা সংশোধন করতে চান তাঁর ভাই।

রহমান ফাইজুর রহিম নামের এক ব্যক্তি জানান, তাঁর ১৭ বছর বয়সী ছেলের জন্মসনদ অনলাইনভুক্ত নয়। তাই তিনি ছেলের জন্য নতুন আবেদন জমা দিতে এসেছেন।

ফরহাদ খান নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, তিনি তাঁর ছয় মাস বয়সী ছেলের পাসপোর্ট করবেন। তাই তার জন্মনিবন্ধনের আবেদন জমা দিতে এসেছেন।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, সংস্থাটির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধন করে জন্মসনদ নিয়ে পাসপোর্ট করতে গিয়ে কয়েকজন ব্যক্তি বিপাকে পড়েছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা ডিএসসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে যোগাযোগ করে তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের জন্মসনদ নম্বর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে পাসপোর্ট আবেদন ফেরত দিয়েছে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য জমা হয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় নিয়ন্ত্রিত তথ্যভান্ডারে। নিবন্ধন নম্বরের মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ের জন্য এই কার্যালয়ের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তযোগাযোগের এমওইউ আছে।

অন্যদিকে, ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধন করা ব্যক্তিদের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে জমা হচ্ছে না। আবার ডিএসসিসির সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমওইউ নেই। তা ছাড়া এমওইউ করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদন লাগে। এই অনুমোদনও ডিএসসিসির নেই। এ কারণে ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধন করে জন্মসনদ নেওয়া ব্যক্তিরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ অক্টোবর ২২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে একটি চিঠি ইস্যু করে ডিএসসিসি। চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ যাচাইয়ে ডিএসসিসির সার্ভারে ক্লিক করে কিউআর কোড ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

এমওইউ ছাড়া সেবা পাওয়া যাবে না

বর্তমানে ডিএসসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিবন্ধনের কাজ চলছে। ডিএসসিসির অঞ্চল ২-এর কার্যালয়ে ৪ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬৮টি জন্মনিবন্ধনের নতুন আবেদন জমা হয়েছে। সনদ পেয়েছেন ৫৩৬ জন। এই সময়ে এখানে কোনো মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদন হয়নি।

ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে শুধু নতুন আবেদন নেওয়া হচ্ছে। নতুন আবেদনে সংশোধনের প্রয়োজন হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে করে দেওয়া হচ্ছে। আর দক্ষিণ সিটির বাসিন্দাদের যাঁরা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের অধীন আগে সনদ নিয়েছিলেন, তাঁদের সংশোধন আবেদন ডিএসসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো গ্রহণ করে তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে জন্মসনদের প্রয়োজন হয়। ডিএসসিসি এখন যে জন্মসনদ দিচ্ছে, তার মাধ্যমে সেবা পাওয়ার পথ খুলতে সংস্থাটিকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে শুরু করে অন্তত ২২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ সই করতে হবে। তা ছাড়া জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের বিদ্যমান আইন-বিধি সংশোধন করতে হবে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদন লাগবে। তা না হলে ডিএসসিসির এই সনদ দিয়ে সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হবে।

অবশ্য ডিএসসিসির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সংস্থাটির জন্মসনদে কোনো সমস্যা হবে না বলে তাঁরা মনে করছেন।