আট মাসের মাইশা ইসলামের চার দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর। কোনোভাবেই জ্বর কমছে না, সঙ্গে আছে সর্দি-কাশি। উপায়ান্তর না দেখে শেষমেশ হাসপাতালে মাইশাকে নিয়ে ছুটে এসেছেন মা আনোয়ারা বেগম। রাজধানীর মিরপুরের এই বাসিন্দা বললেন, ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফেরার পরই মেয়ের জ্বর আসে। জ্বরের মাত্রা বেশি দেখে হাসপাতালে এসেছেন। শিশু হাসপাতালে এসে দেখেন তাঁর মতো আরও অনেকেই শিশুদের একই সমস্যা নিয়ে এসেছেন।
দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের কারণে মানুষ অস্বস্তিতে ভুগছে। এতে শিশুরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আজ শনিবার রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু রোগীদের বেশির ভাগই জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। চিকিৎসকেরা বলছেন, এবারের জ্বরের ধরনও আলাদা। প্রচণ্ড জ্বর, যা সাধারণ ওষুধ খেয়েও সারছে না। এ জ্বর কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক শাহেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ রোগী আসছে সর্দি-জ্বর নিয়ে। পরিস্থিতি খুব জটিল না হলে ভর্তি রাখা হচ্ছে না। কারণ, এই গরমে শিশুদের বাসায় থাকাই ভালো।
জ্বরের ধরন প্রসঙ্গে শাহেদুর রহমান বলেন, রোগীদের মধ্যে অনেকের জ্বর ১০৩ থেকে ১০৫ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। মুখে খাওয়ার প্যারাসিটামলেও অনেক সময় জ্বর নামছে না বা নামলেও আবার একই মাত্রার জ্বর উঠছে। জ্বরের ধরন বোঝার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) নমুনা (স্যাম্পল) পাঠানো হয়েছে।
রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা গেল, তিন মাসের শিশু ওমরের নাক ও মুখে অক্সিজেন মাস্ক। মায়ের কোলে চড়ে সে হাসপাতালে এসেছে। শিশুটির মা লিমা জানান, তাঁদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ওমরের নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। ওমরকে নিয়ে এর আগে এক সপ্তাহ একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছিলেন। শিশু হাসপাতালে এসেছেন পাঁচ দিন আগে।
শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি হলে ওষুধ ও পরামর্শ দিয়ে রোগীকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নিউমোনিয়ার লক্ষণ, ডায়রিয়া বা রোগীর অন্য জটিলতা থাকলে ভর্তি করে নেওয়া হচ্ছে।
শিশু হাসপাতালের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সেখানে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে এই সংখ্যা ছিল ২২৬। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ছিল ৩১২। কিন্তু এবার এপ্রিলের ১৯ দিনে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে ২৬৬ শিশু। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, ঈদ ও বৈশাখের লম্বা ছুটিতে অনেকেই ঢাকার বাইরে ছিল। ছুটি না থাকলে রোগী আরও বাড়ত।
আইইডিসিআর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) সম্প্রতি এক যৌথ পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে ইনফ্লুয়েঞ্জার (শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ) প্রাদুর্ভাব বাড়ে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা, খারাপ লাগা বোধ করা, গলাব্যথা ও নাক দিয়ে সর্দি ঝরার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাবের মৌসুমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবহাওয়া পরিস্থিতি। এপ্রিলের শুরু থেকেই তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। মাঝে একটু বৃষ্টি হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। আবহাওয়া দপ্তরও বলছে, এপ্রিলজুড়েই এ অবস্থা থাকবে। গত বৃহস্পতিবার পরবর্তী তিন দিনের জন্য দেশে তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করা হয়। আজ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক সপ্তাহ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগে দুই বছরের ছেলে আবু হুরাইরাকে চিকিৎসক দেখিয়ে ফিরছিলেন মামুন হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিন ধরে ছেলের জ্বর ও কাশি। আজ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। এই বাবা বলেন, যে গরম পড়েছে, তাতে বড়রা বুঝেশুনে চলাফেরা করলেও বাচ্চারা ছোটাছুটি করে, ঘামে আবার বাইরের খাবার খাচ্ছে। তাতে ওদের নিয়ে চিন্তা বেশি।
শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক ফারহানা আহমেদ বলেন, হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ রোগী আসছে সর্দি-জ্বর নিয়ে। চলমান পরিস্থিতি শিশুদের জন্য অনেক কষ্টের। এতে অসুস্থ হয়ে শিশুরা খাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে তাদের শরীর দুর্বল হয়। পানিশূন্যতায় ভোগে। সাধারণ কিছু বিষয় তিনি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে শিশুদের। ঘাম শুকিয়ে যায়, এমন সূতির জামা পরিয়ে রাখতে হবে। বাইরে থেকে আসার পর ঘাম মুছে দিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না।