ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। দুই তরুণ অটোরিকশায় করে ফিরছিলেন। তাঁদের থামালেন সাত-আটজন তরুণ। তারপর তাঁদের কুপিয়ে আহত করা হলো। রাস্তার একপাশে পড়ে রইলেন নিথর একজন।
ঢাকার মিরপুরের ঘটনা এটি। গতকাল শনিবারের। সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও চিত্রে ধরা পড়েছে এই দৃশ্য। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘটনায় এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। আরেকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নিহত তরুণের নাম মো. ফয়সাল (২৫)। তিনি পল্লবীর মুড়াপাড়া বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা। পেশায় তিনি কারচুপি কারিগর। আহত হয়েছেন তাঁর বন্ধু রাশেদ। পুলিশ বলছে, এক নারীর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে তরুণকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ দুজনকে আটক করেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজুমল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, হত্যায় আটজন অংশ নেন। আটক হওয়া দুজনকে নিয়ে অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
পুলিশ ও নিহত ফয়সালের স্বজনেরা জানান, গতকাল সন্ধ্যায় ফয়সাল তাঁর বন্ধু রাশেদকে নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ইফতার পার্টিতে যান। সেখান থেকে তাঁরা অটোরিকশায় বাসায় ফেরার সময় হামলা হয়। ঘটনার সময় রাস্তায় অনেক মানুষ ছিলেন, দোকানপাট খোলা ছিল, যানবাহনও চলছিল।
সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, দুর্বৃত্তরা অটোরিকশার গতিরোধ করে দুই তরুণকে নামিয়ে মারধর শুরু করে। একজনকে রাস্তার একদিকে নিয়ে যায়। আরেকজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি ব্লকে।
পুলিশ বলছে, আটক হওয়া দুজনের মধ্যে একজন সরাসরি হত্যায় অংশ নেন। তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ঘটনায় আজ রোববার সকাল পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিহত ফয়সাল সপরিবার মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের মুড়াপাড়া বিহারি ক্যাম্পের ই ব্লকে থাকতেন। ফয়সালের প্রতিবেশী তানজিলা আক্তার নামের এক নারীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। ফয়সালের পাশের বাসায় তাঁর বান্ধবী থাকেন। কিছুদিন পর ফয়সালের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
আরও জানা গেছে, তিন দিন আগে তানজিলার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে গান গেয়েছিলেন ফয়সাল। তানজিলা ধরে নেন তাঁকে ব্যঙ্গ করে ফয়সাল গান গেয়েছেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের দুজনকে নিবৃত্ত করেন। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে একই বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে আবার কথা–কাটাকাটি হয়। এ সময় ফয়সাল তানজিলার গায়ে একটি লাঠি ছুড়ে মারেন। দুজনের মধ্যে আবার হাতাহাতি হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাশেদ বলেন, এই বিরোধ থেকেই তানজিলার স্বামী আকাশ, তাঁর বন্ধু কাল্লু মিয়া ও তানজিলার বড় ভাই শাহীনসহ আটজন তাঁদের ওপর হামলা করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা নাজমুল হাসান বলেন, পথচারীরা রক্তাক্ত অবস্থায় ফয়সাল ও রাশেদকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়। সেখান থেকে তাঁদের রাত পৌনে আটটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক ফয়সালকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফয়সালের বাবা শাহাদত হোসেন তাঁত কারখানায় কাজ করেন। তাঁর চার ছেলের মধ্যে তৃতীয় ছেলে ফয়সাল।
শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তানজিলার স্বামী আকাশ ও ভাই শাহীন তাঁর নিরপরাধ ছেলেকে খুন করেছেন। তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান।
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ২০২১ সালের ১৬ মে ৬ বছর বয়সী শিশুসন্তানের সামনে যুবক সাহিনুদ্দিনকে (৩৩) কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলেছে, লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের ইন্ধনে খুনটি করা হয়েছিল।
এম এ আউয়াল ইসলামী গণতন্ত্রী পার্টির চেয়ারম্যান। তিনি খুনের মামলায় জামিনে রয়েছেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি ‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট’ নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করেন। জোটের নেতারা বলেছিলেন, তাঁরা সরকারের সঙ্গে থাকতে চান।
পিবিআই, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব সূত্র তখন জানিয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ড-সংশ্লিষ্ট একটি অডিও ক্লিপ তাদের হাতে আসে। সেখানে শোনা যায়, হত্যাকারীদের একজন আউয়ালকে ফোন করে বলছেন, ‘স্যার, ফিনিশ।’
তখন ওই ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে দেখা যায়, দুই যুবক চাপাতি দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে কোপাচ্ছিলেন।