জমিদার শেখ গোলাম মোহাম্মদের মৃত্যুর পর স্ত্রী সিতারা বেগম ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিংটোলায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন পুরান ঢাকায়। স্বামীর স্মরণে নির্মাণ করলেও কালক্রমে মসজিদটি সিতারা বেগমের নামেই পরিচিতি পায়।
প্রয়াত স্বামীর স্মরণে মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন সিতারা বেগম। তারপর কত কত উত্থান-পতন ঘটেছে, দেশে, সমাজে। সেই সব পালাবদলের আনন্দ–বেদনার স্মৃতির নীরব সাক্ষী হয়ে আছে পুরোনো ঢাকার শিংটোলার তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি। তবে মসজিদটি এখন পরিচিত তাঁর নিজের নামেই। ‘শিংটোলা সিতারা বেগম জামে মসজিদ’।
শিংটোলা পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের পূর্ব দিকে। লক্ষ্মীবাজার দিয়েও সরু গলিপথ ধরে যাওয়া যায়। ঢাকার একটি প্রাচীন জনপদ এই শিংটোলা। নাজির হোসেন তাঁর ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সিং পদবির লোকেরা বসবাস করতেন। তাঁদের সূত্রেই এলাকাটির নাকরণ ‘সিংটোলা’ বা ‘শিংটোলা’। এই সিং মানুষজন উত্তর ভারত ও পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। এককালে তাঁদের নেতা ছিলেন লালা মিত্রজিৎ সিং। এখন আর তাঁদের কেউ এখানে নেই।
শিংটোলার আশপাশেই ছিল পর্তুগিজদের বাসস্থান। জমিদার শেখ গোলাম মোহাম্মদ পর্তুগিজদের বাড়ি কিনে সেখানে নতুন করে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন। গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন ঢাকার নায়েবে নাজিম নবাব জেসারত খানের সময়ের বিখ্যাত জমিদার শেখ গোলাম নবীর তৃতীয় পুত্র। তাঁরা পিতা-পুত্র নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জের কদমরসুল দরগা সংস্কারের জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। গোলাম মোহাম্মদ একসময় ঢাকায় পর্তুগিজ ফ্যাক্টরির এজেন্ট ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী সিতারা বেগম হিজরি ১২৩১ মোতাবেক ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিংটোলায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। স্বামীর স্মরণে নির্মাণ করলেও কালক্রমে মসজিদটি সিতারা বেগমের নামেই পরিচিতি পায়।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আহমদ হাসান দানী তাঁর ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইতে মসজিদের এই ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মসজিদের শিলালিপি থেকে এর নির্মাণকাল জানা গেছে। সেই হিসাবে শিংটোলার এই মসজিদের বয়স চলছে ২০৫ বছর।
আদি মসজিদটি এখনো টিকে আছে। তবে বেশ কয়েক দফায় সম্প্রসারণ ও চারদিকে অনেক বহুতল ভবন তৈরি হওয়ায় ছাদে ওঠা ছাড়া আদি মসজিদের তিন গম্বুজ দেখা যায় না। মাঝের গম্বুজটি বড়। এটির রং সবুজ। পাশের দুটি আকারে একটু ছোট, এই দুটি সম–আকারের। এই গম্বুজ দুটির রং উঠে গেছে। অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজগুলোর চূড়ায় ফুলের নকশা করা।
অধ্যাপক দানী উল্লেখ করেছেন, মসজিদটি একটি উঁচু ঢিপির ওপরে নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের সামনের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সামনের অংশের দুই কোণে ছিল অষ্টকোণের নকশাযুক্ত মিনার। পূর্ব দিকের দেয়ালে ছিল খিলানাকৃতির তিনটি প্রবেশপথ। এর মাঝেরটি আকারে বড়। শায়েস্তাখানি স্থাপত্যরীতিতে মসজিদটি নির্মিত।
সিতারা বেগম মসজিদের সামনের দৃশ্য এখনো বেশ সুন্দর। নতুন ভবনটি চারতলা। সামনে নিচের তলার বহির্বিশ্বের দেয়াল মার্বেল ফলক দিয়ে আচ্ছাদিত। আলো–বাতাস প্রবেশের জন্য খিলান আকারের জানালা করা। ভেতরে নকশা করা লোহার গ্রিল বসানো। মসজিদটি এখনো রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। খিলান আকারের মূল প্রবেশপথের সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।
আদি মসজিদটির খুব বড় নয়। ভেতরে মুসল্লিদের জন্য তিনটি সারি। গম্বুজগুলো ভেতর থেকে খোলা রাখা হয়েছে। ফলে গম্বুজের ভেতরে নকশা দেখতে অসুবিধা হয় না। এর কিনার দিয়ে অর্ধবৃত্তাকার নকশা খচিত। পশ্চিমের দেয়ালে একটি মেহরাব। উত্তর–দক্ষিণে দুটি এবং পূর্বের দেয়ালে তিনটি দরজা। তবে ভেতরের দেয়ালগুলো সাদা মার্বেল ফলক দিয়ে আচ্ছাদিত। পশ্চিমে দেয়ালের কালো রঙের ধনুক আকৃতির নকশা ফুটিয়ে তোলা।
মসজিদের সম্প্রসারিত অংশে ভেতরের দৃশ্য বেশ অন্য রকম। সম্প্রসারণের সময় দ্বিতীয় তলায় পুরোনো মসজিদের সামনের দিকে অর্ধবৃত্তাকার বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা রাখা। তৃতীয় ও চতুর্থতলায় এই ফাঁকা স্থান ক্রমে কমে গেছে। ফলে আলো–বাতাসের অবাধ প্রবাহ তৈরি হয়েছে ভেতরটায়।
গত বুধবার দুপুরে জোহরের নামাজের পর কথা হলো মসজিদ পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ মো. নাসির উদ্দিন আহমদ, সদস্য মো. আবদুর রশিদ প্রবীণ মুসল্লি, মো. আবদুর রহমানসহ অনেকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, অনেকবার এই মসজিদের সংস্কার ও কয়েক দফায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই মসজিদের অনেক জায়গা ছিল। একটা সময় প্রভাবশালী মানুষেরা মসজিদের জায়গা দখল করে ফেলেন। ব্রিটিশ আমলে মসজিদের সামনে একটা ঘোড়ার আস্তাবল করা হয়েছিল। ভারত ভাগের পরে তৎকালীন খতিব মাওলানা আবদুল বারী স্থানীয় বাসিন্দা ও ফরিদাবাদ মাদ্রাসার তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে দখল উচ্ছেদ করে অনেকটা জায়গা পুনরুদ্ধার করেন। আস্তাবল সরিয়ে বারান্দা সম্প্রসারণ করেন। পরে ধাপে ধাপে আরও সম্প্রসারণ ও পাকা ভবন করা হয়েছে।
এই মসজিদে এখন প্রায় ১৬ কাঠা জায়গা রয়েছে। শিংটোলার ৫/১ প্রতাপ দাস লেনে সিতারা বেগম মসজিদের অবস্থান। মসজিদের ভবন ছাড়াও বাকি জায়গায় একটি মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু জায়গায় দোকানপাট ও একটি প্রিন্টিং প্রেসকে ভাড়া দেওয়া। এ থেকে পাওয়া আয় আর এলাকাবাসীর দানেই মসজিদটির নির্মাণ ও পরিচালনার খরচ মেটানো হচ্ছে। একসঙ্গে তিন হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজে অংশ নিতে পারেন। শুক্রবার ছাদ ও সামনের রাস্তাতেও জামায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। পরিচালনা কমিটির নেতারা জানান, বাস্তব প্রয়োজনেই মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আদি মসজিদটি যেন টিকে থাকে। যেন এর কোনো ক্ষতি না হয়।
সামনে থেকে পুরোনো মসজিদটি দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে মসজিদে প্রবেশ করলে ভেতরটা দেখতে পাওয়া যাবে। আর খুব কৌতূহলী যাঁরা, তাঁরা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে মসজিদের গম্বুজও দেখতে পারবেন। কোনো প্রাচীন স্থাপনা একবার ভেঙে ফেললে তো চিরতরে শেষ। নতুন করে হয়তো বিলাসবহুল বহুতল ভবন তৈরিও করা যাবে; কিন্তু স্মৃতির স্পর্শ লেগে থাকা অমূল্য প্রাচীন স্থাপত্যকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না কিছুতেই। এভাবেই চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে ঢাকার অনেক প্রত্ননিদর্শন। অনেক প্রাচীন মসজিদ। এখনো যেগুলো টিকে আছে, তা রক্ষা করা কি একেবারেই অসম্ভব?