ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জনগণের কাছ থেকে কর আদায়ে যতটা সচেষ্ট, সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ততটা নয়। গত চার অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব আদায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে নাগরিক সেবা বাড়েনি। বরং বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।
‘সচল, সুন্দর, সুশাসিত ও উন্নত’ ঢাকা বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২০ সালের ১৬ মে দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। ইতিমধ্যে চার বছর পার হয়েছে। কিন্তু ‘সচল ঢাকার’ অন্যতম শর্ত যানজট নিরসন তো দূরের কথা, বরং সেটা আরও বেড়েছে। জলাবদ্ধতার সমস্যাও রয়ে গেছে। মশকনিধনেও সফলতা দেখাতে পারেনি সিটি করপোরেশন। ফলে আগের তুলনায় ডেঙ্গুর পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বছরজুড়ে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির যন্ত্রণা থেকেও মানুষ মুক্তি পায়নি। বেশির ভাগ ফুটপাত এখনো বেদখলে।
বাসযোগ্য শহরের তালিকায় কয়েক বছর ধরেই তলানিতে ঢাকা। সর্বশেষ গত ২৬ জুন প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বার্ষিক জরিপের তথ্য বলছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। এ ছাড়া দূষিত শহরের তালিকায় এবং শব্দদূষণেও ঢাকার অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে।
বাসসেবা বন্ধের পথে, টোলের নামে চাঁদাবাজি
গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির মাধ্যমে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামের বাসসেবা চালু করা হয়েছিল। এই কমিটির সভাপতি ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের উদ্যোগে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রথম এই বাসসেবা চালু হয়। পরে আরও দুটি পথে (রুটে) এই সেবা চালু করা হয়। এখন এই বাসগুলো আর ঠিকমতো চলছে না।
রাজস্ব আদায়ের জন্য বাস ও মিনিবাস থেকে টোল আদায় করতে পাঁচটি এলাকার অধীনে অন্তত ৫৭টি স্থান ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। তবে টোল আদায়ের নামে এসব এলাকায় রীতিমতো চাঁদাবাজি হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও চাঁদাবাজি বন্ধে সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অন্য সেবা পেতেও ভোগান্তি
জন্মনিবন্ধন করতে গিয়েও রীতিমতো ভোগান্তিতে আছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির বাসিন্দারা। রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে এক বছর ধরে জন্মনিবন্ধন নিয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন তাঁরা। তবে এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সমস্যাটি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
রাজধানীতে পর্যাপ্ত কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগার ও গ্রন্থাগার নেই। উন্মুক্ত জায়গার অভাব অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তাদের আওতাধীন খেলার মাঠ ও পার্কে খাবারের দোকান ইজারা দিয়েছে। এ নিয়ে নাগরিক সমাজের কোনো আপত্তি আমলে নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।
আয় বেড়েছে দ্বিগুণ
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হিসাব বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৯–২০ অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব আদায় হয় ৫১৪ কোটি টাকা। এরপর ২০২০–২০২১ অর্থবছরে ৭০৩ কোটি টাকা, ২০২১–২০২২ অর্থবছরে ৮৭৯ কোটি টাকা এবং ২০২২–২০২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরের ১ হাজার ৬১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
সংস্থাটি প্রতিবছর ৫২টি খাত থেকে আয় করে। এর মধ্যে গৃহকর খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি, ৩৪৭ কোটি টাকা আয় করেছে। একই অর্থবছরে রিকশার লাইসেন্স খাতে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং বিভিন্ন সংস্থাকে সড়ক খননের অনুমতি দিয়ে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে।
এ ছাড়া বাজার সালামি (সিটি করপোরেশনের মার্কেট বা দোকান বরাদ্দ দেওয়ার আগে নেওয়া অগ্রিম টাকা) খাতে বছরে গড়ে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা আয় করে দক্ষিণ সিটি। বাস ও ট্রাক টার্মিনাল ইজারা দিয়েও বছরে গড়ে ১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা আয় করে। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের খাত থেকে বছরে অন্তত সাড়ে ৯ কোটি টাকা আয় করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
সেবার দিকে আরও নজর দিতে হবে
সেবা নিশ্চিত করার চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ব্যবসায়ী মনোভাব বেশি বলে মনে করেন এই সিটির বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করা স্থপতি ইকবাল হাবিব। নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই স্থপতি প্রথম আলোকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনের নামে রীতিমতো মানুষের সঙ্গে ‘হঠকারিতা’ করা হয়েছে। রাজধানীর খালের দায়িত্ব নেওয়ার পর এর ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) না করেই সেখানে ‘খামচাখামচি’ করা হচ্ছে। তাই পানি ঠিকমতো নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। ধানমন্ডি লেকসহ পার্কগুলোকে ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। এমন মানসিকতা থেকে সরে এসে করপোরেশনকে নাগরিক সেবার দিকেও নজর দিতে হবে।
তবে রাজস্ব আদায়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সেবা বাড়ানোর প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যানজট নিরসনের লক্ষ্যে রাজধানীর ভেতরে থাকা বাস টার্মিনাল শহরের বাইরে নেওয়া হচ্ছে। আগে বৃষ্টিতে নগরীর ৭০ শতাংশ এলাকা প্লাবিতো হতো। এটি ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। মশা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জনবল বাড়িয়ে বেশি সময় ধরে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এ ছাড়া সিটি টোলের নামে কেউ চাঁদাবাজি করে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান মেয়র।
সিটি করপোরেশনের দিক থেকে নাগরিক সেবা বৃদ্ধির বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে।
বিআইপির সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা ও উদ্যোগ না থাকা এ নগরীর অন্যতম সমস্যা। ওয়ার্ডভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও চার বছরেও তা শেষ হয়নি। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদির উন্নতি হয়নি। খাল উদ্ধার ও বর্জ্য পরিষ্কার কার্যক্রম টেকসই হচ্ছে না। তাঁর মতে, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনকে আরও আন্তরিক হওয়া দরকার।