ঢাকা ও এর আশপাশে ২৫ প্রতিষ্ঠানের ৪১ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ

ভূমিকম্পের বিবেচনায় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন ভাঙার অগ্রগতি নেই। এমনকি ভবনগুলো খালি করতে দেওয়া নির্দেশনারও বাস্তবায়ন হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের ঝুঁকিপূর্ণ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভবনের ওপরেই সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সম্প্রতি তোলা

রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘এ’ ব্লক। ভবনটির নিচতলায় বিপণিবিতান। সেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসেন। কিন্তু ভূমিকম্পের বিবেচনায় ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবনটি ভাঙতে বলেছে। তবে রাজউক বা মালিকপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

শুধু বিএসএমএমইউর ‘এ’ ব্লক নয়, রাজউকের আওতাধীন এলাকায় এমন আরও ৪১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পেয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে একটি ভবন ভাঙা হয়েছে। বাকি ৪১টি ভবন ভাঙা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ৩ হাজার ২৫২টি সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভবন ‘র‌্যাপিড ভিজ্যুয়াল অ্যাসেসমেন্ট’ করা হয়। এরপর এসব ভবনের মধ্যে তুলনামূলক খারাপ এমন ৫৭৯টির ‘প্রিলিমিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট’ (পিইএ) করা হয়। এতে দেখা যায়, ৪২টি ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এগুলো ভাঙার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্পের কারিগরি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের ভূমিকম্পসংক্রান্ত ম্যাপ অনুযায়ী ৪২টি ভবন খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, পুরোনো ভবন মজবুত করার খরচ নতুন করে নির্মাণ ব্যয়ের ৪০ শতাংশের বেশি হলে সেটি ভাঙার সুপারিশ করা হয়। এই ৪২টি ভবনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে ঐতিহাসিক মূল্য আছে, এমন ভবন মজবুতকরণের (রেট্রোফিটিং) মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে পারে।

অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় বিএসএমএমইউর ‘এ’ ব্লক ছাড়াও ‘বি’ ও ‘ডি’ ব্লক রয়েছে। এই তিন ব্লকসহ রাজধানীতে ২৩টি, গাজীপুরে ৩টি, সাভারে ৬টি, নারায়ণগঞ্জে ৮টি ও কেরানীগঞ্জে ১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এই ৪১ ভবনের মধ্যে পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের একটি ভবন শত বছরের পুরোনো। বাকিগুলো ষাটের দশকে বা তার পরে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০০ সাল বা তার পরে নির্মিত ভবন আছে চারটি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর মধ্যে তিন ও চারতলা ভবনের সংখ্যা ২৫। এ ছাড়া একটি ১৭ তলা ও একটি ১০ তলা ভবন আছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনের তালিকা প্রকাশ করেনি রাজউক। তবে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য সংগ্রহ করে ভবনগুলোর নাম ও ঠিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন এই প্রতিবেদক।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, সম্প্রতি নগর উন্নয়ন কমিটির এক বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে তা আর প্রকাশ করা হয়নি। এ অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় রাজউককে নিতে হবে। সম্প্রতি (১২ এপ্রিল) বিএসএমএমইউর ‘এ’ ব্লক ঘুরে দেখা গেছে, নিচতলায় শাহবাগ বিপণিবিতান। এখানে ৪৯টি দোকান (ওষুধ, ব্যাগ ও মুদিদোকান) ও ৪টি রেস্তোরাঁ আছে।

এখানে কথা হয় মেসার্স মেডিকোর্সের মালিক আজিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাজউকের প্রধান কার্যালয়ই তো ঝুঁকিপূর্ণ। এই ভবন (বিপণিবিতান) ভাঙার আগে রাজউকের নিজের ভবন ভাঙা উচিত।’ রাজউকের পরীক্ষার প্রতি তাঁর আস্থা নেই উল্লেখ করে বলেন, বুয়েটের মাধ্যমে আবার পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

‘এ’ ব্লকে বিপণিবিতান ছাড়াও বিএসএমএমইউর ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ক্যানটিন, সেমিনার কক্ষ ও হোস্টেল আছে।

এই ভবন ছাড়াও ‘বি’ ব্লক (বেসিক ট্রিটমেন্ট সায়েন্স বিল্ডিং) ও ‘ডি’ ব্লকের ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছে রাজউক। এর মধ্যে ‘ডি’ ব্লক তুলনামূলক নতুন। ২০০৭ সালে ১৭ তলা এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডি’ ব্লকের ভবনটি বেশি দিন আগের নয়। এই ভবনের ব্যাপারে আবার ‘রিভিউ’ করতে রাজউককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির উত্তর পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লক সম্পর্কে তিনি বলেন, এ দুটি ভবনও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায় তো তাঁদের ওপরই পড়বে। তাই রাজউক থেকে পরবর্তী নির্দেশনা পেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিএসএমএমইউর চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী বলেন, বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ রাজউকের সুপারিশ চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে বুয়েটের মাধ্যমে ভবন পরীক্ষা করাতে পারেন। রাজউকের পক্ষে আবার ভবন পরীক্ষার সুযোগ নেই।

রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ২৩ ভবন

বিএসএমএমইউর তিনটি ছাড়া অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হচ্ছে বাড্ডা আলাতুন্নেছা উচ্চবিদ্যালয়ের দুটি (শিক্ষক মিলনায়তন ও একাডেমিক ভবন), ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তিনটি ভবন (মূল ভবন, বিজ্ঞান ভবন ও হল ভবন), দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্বাধীনতা ভবন, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের বিজ্ঞান ভবন (ভবন নম্বর-৩), ডেমরার হায়দার আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ভবন (এই প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি তিনতলা ভবন ভাঙা হয়েছে), মিরপুরের হাজী আলী হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের চারতলা বিদ্যালয় ভবন, পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের ১ ও ২ নম্বর ভবন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), সায়েদাবাদের কোরাটিটোলা সিএমএস মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের একটি ভবন (স্কুল ও কলেজ ভবন), যাত্রাবাড়ীর শহীদ জিয়া বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), তেজগাঁও মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ভবন (সামাজিক ভবন-১ ও কলাভবন) এবং বাড্ডার ছোলমাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ভবনকে চারটি অংশে বিভক্ত করে পরীক্ষা করা হয়েছে। ফলে বাস্তবে দুটি ভবন হলেও রাজউক সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ চারটি ভবনের নাম উল্লেখ করেছে। এগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভবন, অর্থনীতি বিভাগ ভবন, কলাভবন ও কলাভবনের বাঁ অংশ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, রাজউক থেকে কোন কোন ভবনকে নির্দিষ্ট করে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে, তা তাঁরা শনাক্ত করতে পারেননি। তাই তাঁরা ভবন চিহ্নিত করে দিতে রাজউককে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারতলা সামাজিক বিজ্ঞান ভবন-১-এ অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম চলে। এ ভবনে শিক্ষক মিলনায়তন, শ্রেণিকক্ষ, সেমিনার ও বিভাগীয় কার্যালয় রয়েছে।

রাজধানীর পরেই নারায়ণগঞ্জ

রাজধানীর পরেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। এখানে আটটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে রয়েছে সরকারি কদম রসুল কলেজের প্রশাসনিক ভবন, নারায়ণগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের তিনটি ভবন (একাডেমিক ভবন ১, ২ ও প্রশাসনিক ভবন), নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের জাহানারা ইমাম ভবন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভবন, দোলপাড়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের দুটি ভবন (ভবন নম্বর ২ ও ৪)।

নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে মোট চারটি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে দোতলা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। ৬ এপ্রিল দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনে আরও একতলা বাড়ানোর কাজ চলছে।

মুঠোফোনে কলেজের অধ্যক্ষ বেদৌরা বিনতে হাবিব বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই কলেজে দুটি ভবন ভাঙা হলে আমরা শিক্ষার্থীদের ক্লাস কোথায় নেব?’

ভাঙতে বললেই ভাঙা যায় না

গাজীপুর, সাভার ও কেরানীগঞ্জে ঝুঁকিপূর্ণ মোট ১০টি ভবনের অন্যতম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল। প্রজাপতির আদলে তৈরি এই হলকে তিনটি ভবন হিসেবে দেখিয়েছে রাজউক। চারতলা এই হলে কক্ষ আছে ৪৯০টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজউক ভবনটি ভাঙতে বলেছে। কিন্তু ওই হলে আট শতাধিক শিক্ষার্থী থাকে, তাদের আমরা কোথায় রাখব। ভাঙতে বললেই তো ভাঙা যায় না।’

সাভারের ঝুঁকিপূর্ণ অন্য ভবনগুলো হচ্ছে দারুল ইসলাম ফাজিল মাদ্রাসার একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), শ্যামলাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন এবং ভাকুর্তা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের একটি ভবন (একাডেমিক ভবন-১)।

এ ছাড়া গাজীপুরের সরকারি কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজের ১ ও ২ নম্বর ভবন, কালীগঞ্জ আর আর এন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের এ কে এম ফজলুল হক ভবন এবং কেরানীগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের একটি ভবন (ভবন নম্বর ১) রয়েছে।

ভবন খালি হয়নি

রাজউক এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে গত ১১ মার্চ নগর উন্নয়ন কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ঝুঁকিপূর্ণ ৪২টি (ইতিমধ্যে ভাঙা ভবনটিসহ) ভবন সাত দিনের মধ্যে খালি করার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজউককে।

৬ থেকে ১২ এপ্রিল সরেজমিনে ১০টি ভবন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, একটি ভবনও খালি করা হয়নি।

এ অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কার, জানতে চাইলে গত ১৩ এপ্রিল রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস বলেন, এসব ভবন রাজউকের নয়। ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন খালি করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভবন খালি ও ভাঙার কাজ তাদেরই করতে হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মজিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ; আল-আমিন, গাজীপুর; আশিকুজ্জামান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)