সরকার পরিবর্তনের পর রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এর পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে আবারও দোকানপাট তৈরির কাজ শুরু করেছে একটি চক্র। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় ৯০০টি দোকান তৈরি করতে ওই চক্রটি এবার সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে অবৈধভাবে সেখানে দোকান তৈরির কাজ শুরু করেছে। সবশেষ শুক্রবার বিকেলে স্থানীয় কাউন্সিলর গিয়ে সেখানে দোকান তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবন লাগোয়া দক্ষিণ পাশেই ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট–২। সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা ও জাকের সুপার মার্কেট—এই তিনটি বিপনিবিতানের নাম ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২। এই মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। তখন তিনটি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ৯১১টি অবৈধ দোকান গুড়িয়ে দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি। এরপর পার্কিংয়ের জায়গা থেকে দোকানপাট সরিয়ে সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা ও জাকের সুপার মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গায় নতুন দোকান তৈরির কাজ চলছে। পার্কিংয়ের ফটকে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে, যাতে ভেতরে যে নির্মাণ কাজ চলছে তা বাইরে থেকে বোঝা না যায়।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরদিন পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান তৈরি করতে আবারও উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ওই মার্কেটের দোকানিরা। সিটি প্লাজায় দোকানি মোহাম্মদ সোহেল, জাকের সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদসহ কয়েকজন ব্যক্তি এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের কয়েকজন দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, সেনাবাহিনীকে ম্যানেজ করা হয়েছে—এমন তথ্য ছড়িয়ে পার্কিংয়ের জায়গায় আগে যাদের দোকান ছিল তাদের থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে তোলা শুরু করেন সোহেল। পাশাপাশি মার্কেটের গাড়ি পার্কিংয়ের মূল ফটকে ‘সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ লিখে পোস্টার লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই পোস্টারে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বরও দিয়ে দেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীর নাম ও নম্বর দিয়ে পোস্টার লাগানোর কারণে আস্থা পেয়ে দোকান নির্মাণ করতে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সিটি প্লাজার এক দোকানি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোহাম্মদ সোহেল অন্য দোকানিদের বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। যেহেতু সরকার নাই, মেয়র নাই, এই সুযোগে দোকান তৈরি করে ফেলি। পরে কি হয় দেখা যাবে।’ এমন আশ্বাস পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা দোকান নির্মাণ করতে টাকা দিয়েছেন।
ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটে সেনাবাহিনীর নাম দিয়ে যে পোস্টার লাগানো হয়েছে, ওই পোস্টারে দেওয়া নম্বরে বৃহস্পতিবার রাতে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো কোনো দখলদারের হয়ে কাজ করে না। কেউ যদি এমনটা করে থাকে তারা খবর নিয়ে দেখবেন।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দোকানি মোহাম্মদ সোহেলসহ কয়েকজন এবং স্থানীয় কাউন্সিলর মোহাম্মদ মামুনকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শুক্রবার ডেকে নেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের মার্কেট আগে যেমন ছিল তেমনই যাতে থাকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনার পরও গতকাল দিনভর সিটি প্লাজার পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী তিনজন ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এসে ওই কাজ বন্ধ করে দেন। সেখানে দোকান নির্মাণের কাজে যুক্ত শ্রমিকরা কাউন্সিলরকে জানিয়েছেন কাজ চালিয়ে নিতে দোকানি সোহেল তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
তবে সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে দোকান তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মোহাম্মদ সোহেল। তাঁর দাবি, সেনাবাহিনী নিষেধ করার পরও কে কাজ চালু রেখেছে তা তিনি জানেন না। তিনি আরও বলেন, এবার তাঁরা বৈধ প্রক্রিয়ায় যাবেন। করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন।
পরে যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর মোহাম্মদ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, আগেও পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান বসিয়ে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে একটি চক্র। এবার সেনাবাহিনীর নাম ভাঙিয়ে আরেকটি চক্র সিটি করপোরেশনের মার্কেট দখল করতে চাচ্ছে। তিনি বিষয়টি সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান তৈরির খবর পেয়েছেন। এ বিষয়ে পরবর্তীতে কি করা যায় তা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ সূত্র বলছে, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট–২ এ গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য এখনো ইজারা দেওয়া আছে। ইজারার মেয়াদ শেষ হবে সেপ্টেম্বর মাসে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে দোকান তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলে শুনেছেন।
ওই সূত্রে আরও জানা যায়, ১৯৯৭ সালে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট–২ এ পার্কিংয়ের জায়গায় অস্থায়ীভাবে দোকানিদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অস্থায়ী বরাদ্দের ক্ষেত্রে সাধারণত নিয়ম থাকে সিটি করপোরেশন চাইলে যে কোনো সময় এটি ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু দোকানিরা একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে পার্কিংয়ের জায়গায় স্থায়ীভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্যবসা করে আসছিলেন। ওই মার্কেটে মানুষের হাটাচলার জায়গা, লিফটের জায়গা ও গণশৌচাগারের জায়গা দখল করে অসংখ্য দোকানও তারা তৈরি করেছিলেন। এসব দোকান বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যও করেছে একটি চক্র। ওইসব দোকান ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিটি করপোরেশন ভেঙে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান চালাতে হলে পুলিশ লাগে। কিছুদিন পরে হয়তো তাঁরা পুলিশ পেয়ে যাবেন। অবৈধভাবে কেউ সিটি করপোরেশনের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করলে তা উচ্ছেদ করা হবে বলে জানান তিনি।