পৌষের হিমে বাংলা একাডেমিতে প্রথমা বিজয় বইমেলা

প্রথমা বিজয় বইমেলায় বই দেখছেন পাঠকেরা। বুধবার বিকেলে বাংলা একডেমির বর্ধমান হাউস চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের শিউলি ফুলের গাছটায় এবার অনেক ফুলে এসেছে। সেই গাছের পাশে দাঁড়িয়ে বুধবার বিকেলে সমকালীন কথাসাহিত্যিক, লেখক, অনুবাদকেরা বলছিলেন, বইয়ের কিছুটা ক্রান্তিকাল চলছে। এখন প্রথমার বইয়ের মতো সুসম্পাদিত, নির্বাচিত বই–ই পারে পাঠের আগ্রহ বাড়াতে। কেউ বললেন বইয়ের বিষয় নিয়ে, কারও আলোচনায় এলো প্রকাশনা সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য। সবাই এসেছিলেন প্রথমা প্রকাশনের বইমেলা উপলক্ষে।

প্রথমা বিজয় বইমেলার উদ্বোধনী আয়োজনে অতিথিরা। বুধবার বিকেলে বাংলা একডেমির বর্ধমান হাউস চত্বরে

বুধবার থেকে শুরু হলো ছয় দিনের প্রথমা বিজয় বইমেলা। বাংলা একাডেমির চত্বরে এ মেলার প্রথম দিন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই অবশ্য নরসিংদীর মনোহরদির ‘বীরগাঁও স্বপ্ন সিঁড়ি’ পাঠাগারের জন্য ৪০টি বই কিনেছেন তোফাজ্জল হোসেন। প্রথম আলোকে বললেন, তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে বই কিনতেই এত দূর এসেছেন।

অনেকগুলো ভালো বই একসঙ্গে কিনতে পারার সুযোগ এই মেলা। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হ্রাস আছে প্রথমা প্রকাশনের নির্দিষ্ট বইতে। ২৫ শতাংশ মূল্য হ্রাস অন্যান্য প্রকাশনার বইয়ে। মেলা চলবে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখানে আছে দেশি–বিদেশি নানা  প্রকাশনার বইও।  প্রথমার বইয়ের বিষয় এবং প্রকাশনা মান নিয়ে প্রশংসা করলেন ফরিদপুর থেকে আসা পাঠক আলতাফ হোসেন থেকে শুরু করে আমন্ত্রিত লেখকেরা।

প্রথমা প্রকাশনের পেশাদারত্বের কথা উঠে এলো কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈনউদ্দীনের বক্তব্যে। তাঁর অনুবাদে প্রথমা থেকে প্রকাশিত ক্লিন্টন বি সিলির ‘অনন্য জীবনানন্দ: জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী’ বইটি প্রশংসিত। এ বই প্রকাশে প্রথমা কতখানি যত্ন নিয়েছে, সে অভিজ্ঞতা জানালেন তিনি। অনুবাদক আমিনুল ইসলাম ভূইয়ার কথায় উঠে আসে তাঁর লেখা ‘আকবর আলি খান: লেখালেখির জায়গা জমিন’ বইটি প্রথমা থেকে প্রকাশের অভিজ্ঞতার স্মৃতিকথা। তিনি বললেন, প্রকাশকেরা যে বই প্রকাশের পেছনে অনেক শ্রম দিতে পারে, সে উদাহরণ তৈরি করেছে প্রথমা।

লেখকদের এসব বই পাওয়া যাবে বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হওয়া প্রথমা প্রকাশনের বিজয় বইমেলায়।

মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তিনি বলেন, অস্পর্শ অস্তিত্বকে মানুষের বোধগম্য করার কাজটি করে বই। বাংলাদেশের প্রকাশনার অস্তিত্বকে জোরালো করেছে প্রথমা। বাংলাদেশকে সাজাতে হলে বাংলা ভাষাকে সাজাতে হবে। সে কাজ করছে প্রথমা প্রকাশন।

আলোচনা পর্বের সূচনা করেন কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। স্বাগত বক্তব্যে তাঁর কথায় উঠে আসে, নির্ভুলভাবে সুসম্পাদিত বই প্রকাশের চেষ্টা নিয়ে প্রথমার ১৪ বছরের পথচলার অভিজ্ঞতার কথা। আনিসুল হক বলেন, প্রথমা প্রকাশন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৭০টির বেশি বই প্রকাশ করেছে।

প্রথম বই ‘একাত্তরের চিঠি’, যা লক্ষাধিক কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। প্রথমা প্রকাশন সমকালীন ইতিহাস থেকে শুরু করে ইতিহাসের যে জায়গায় আলো–আঁধারি আছে সেসব জায়গায় আলো ফেলতে চেষ্টা করে বলে উল্লেখ করেন আনিসুল হক।

প্রথমা বিজয় বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বুধবার বিকেলে বাংলা একডেমির বর্ধমান হাউস চত্বরে

প্রথমা প্রকাশনের পরামর্শক অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসানের বক্তব্যে উঠে আসে বইয়ের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা নিয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের দক্ষ নজরদারির কথা। তিনি বলেন, সময়টা বইবিরোধী। তবে মানুষ বই কেনে ও পড়ে না—এই অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত আছে। কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম বললেন, প্রথমা প্রকাশনের এই মেলা আসছে অমর একুশে বইমেলার হাওয়া বইয়ে দিল। প্রথমায় নানা রকমের বইয়ের সম্ভার এক ছাদের নিচে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ বছর প্রকাশিত ‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২–গণপরিষদে রাষ্ট্রভাবনা’ বইটি প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানালেন শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক আসিফ নজরুল। নিজেকে প্রথম আলো পরিবারের একজন সদস্য মনে করেন, তাই এই প্রতিষ্ঠানের সবকিছুর সঙ্গে নিজের অনুভব জড়িয়ে আছে বলে জানান কথাসাহিত্যিক ও মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল।

প্রথমা প্রকাশনের বিজয় বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পদ্মশ্রী ভূষিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, নারীনেত্রী মালেকা বেগম, কথাসাহিত্যিক মাসুদুজ্জামানসহ বাংলা ভাষার অনেক লেখক, কথাসাহিত্যিকেরা। অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। শেষে ছিল রাশেদুজ্জামানের কণ্ঠে লোকসংগীত। প্রকাশনের সমন্বয়ক, অনুবাদক জাভেদ হুসেনের স্বতঃস্ফূর্ত সঞ্চালনায় পুরো আয়োজন ছিল আনন্দময়।

আলোচনা শেষে প্রথমা প্রকাশনের মেরিনা ইয়াসমিন যখন সবাইকে চায়ের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন, তখন মেলার স্টলে ছয় মাসের কন্যা মিরিয়াম রাশীদকে নিয়ে বাংলা বই দেখছিলেন সিরিয়ার দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফাইরুজ আসাদ।

অনেক হাসিমুখ তখন ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাংলা একাডেমি চত্বরে যাঁরা প্রথমা প্রকাশনের বিজয় বইমেলা উপলক্ষে এসেছিলেন।