রুবি গজনবীকে সুরে স্মৃতিতে ছবিতে স্মরণ

রুবি গজনবীর স্মরণ অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) লুভা নাহিদ চৌধুরী, মনিরা এমদাদ, পারভীন হাসান, হামিদা হোসেন, শেখ সাইফুর রহমান ও চন্দ্র শেখর সাহা। বৃহস্পতিবার, রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে
ছবি: দীপু মালাকার

নৈবেদ্য সাজানো হয়েছিল তাঁর ছবি, তাঁর ফেলে যাওয়া কাজের নমুনা, চিত্রকলা, সকৃতজ্ঞ স্মৃতির আলো, সুরে ও সংগীতে। গত ১৪ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন দেশের বয়নশিল্প তথা প্রাকৃতিক রঙের প্রচলনের পুরোধা রুবি গজনবী। তাঁকে স্মরণ করেই ‘নৈবেদ্য’ নামের এই আয়োজন হলো বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে। 

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল নীলয় হালদারের সারেঙ্গি বাদন দিয়ে। তারপর রুবি গজনবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা। পরে তাঁকে নিবেদন করে দুটি গান ‘তোমার ধুলার ধরার পরে’ ও ‘শুধু তোমার বাণী নয়’ পরিবেশন করলেন শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা।

অনুষ্ঠানটি মিলিতভাবে আয়োজন করেছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ ও অরণ্য ক্র্যাফটস। সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বয়নশিল্পী স্বপন কুমার, যশোরের সূচিশিল্পী মমতাজ বেগম, সোনারগাঁর দারুশিল্পী রফিকুল ইসলাম, জামদানি বয়ন শিল্পী মো. জামাল এবং অরণ্যের তিন কারুশিল্পী চান মিয়া, আবু তাহের ও হাফিজ উদ্দিন স্মৃতিচারণা করেন। 

সুরে স্মৃতিতে ছবিতে স্মরণ করা হয় রুবি গজনবীকে। বৃহস্পতিবার, রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে

রুবি গজনবীর জীবন ও কর্ম তুলে ধরেন অরণ্যের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশিন খায়ের। রুবি গজনবীর জন্ম ১৯৩৫ সালে কলকাতায়। তাঁর বাবা ছিলেন বিচারপতি। দেশ ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। রুবি গজনবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ও অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পরে তিনি শিক্ষকতা ও সমাজকর্মে যুক্ত হন।

দেশভাগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মর্মান্তিকতা রুবি গজনবীকে মানুষের প্রতি দরদি ও সমাজকল্যাণ কর্মে নিবেদিত করে তুলেছিল। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের গ্রামাঞ্চলে নারীরা যেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, সেটি তাঁকে বিচলিত করেছিল। তিনি এসব নারীকে সূচিকর্ম শিখিয়ে তাঁদের পণ্য বাজারজাতকরণের ভেতর দিয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।

দেশের বয়নশিল্প তথা প্রাকৃতিক রঙের প্রচলনের পুরোধা রুবি গজনবী

পরে রুবি গজনবী প্রাকৃতিক রং পুনরুজ্জীবিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে ৩০টি ভেষজ রং পাকা করেন; এবং ওই রংগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহারও শুরু করেন।  

ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট কাউন্সিলের সম্মানীয় সদস্য রুবি গজনবী জীবনভর দেশের কারুশিল্পের বিকাশ, কারুশিল্পীদের প্রশিক্ষণ, পণ্যের বাজারজাতকরণ, তাঁদের স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কার প্রদানসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের কারুপণ্যের পরিচিতি তুলে ধরতে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন। তাঁর উদ্যোগেই ২০১৯ সালে ঢাকায় একটি জামদানি উৎসব হয়েছিল এবং জামদানির ইউনেসকোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্তির নেপথ্যে তিনিই প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন।

বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্রশেখর সাহা বলেন, রুবি গজনবী ছিলেন খুবই নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। তিনি কাজ করতে পছন্দ করতেন, প্রচার চাইতেন না। নীরবে কাজ করে গেছেন। প্রাকৃতিক রঙের যে পুনরুজ্জীবন তিনি করে গেছেন, তার ব্যবহার যত দিন থাকবে, তিনিও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

সভাপতির বক্তব্যে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভিন হাসান বলেন, রুবি গজনবী ছিলেন একজন অত্যন্ত পরিশীলিত, পরিমার্জিত রুচির মানুষ। প্রতিটি জিনিস নিখুঁতভাবে দেখার এক অনন্য দৃষ্টি ছিল তাঁর। এই গুণের কারণে তিনি তার কাজকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। এর ফলে বয়নশিল্প হোক বা যেকোনো কারুশিল্প হোক, রুবি গজনবীর পরামর্শ ও পর্যবেক্ষণে উৎকর্ষ লাভ করেছে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে রুবি গজনবীকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ চলছে। এ ছাড়া রুবি গজনবীর প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে তৈরি শাড়ি, সিল্ক ও সুতি কাপড়, নকশিকাঁথা, রঙের উপকরণ, সুতা, ব্লক, নকশার বই, আলোকচিত্র এবং প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। এই প্রদর্শনী চলবে ১১ মার্চ পর্যন্ত।