নারী নির্যাতন প্রতিরোধের প্রকল্পটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও জরুরি বিবেচনায় আরও ৬ মাসের জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সময় বাড়লেও অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড়ের অনুমতি না দেওয়ায় দুই মাস ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না প্রকল্পে কর্মরত লোকজন। তবে গত ২ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা অর্থ ছাড়ের অনুমোদন দিয়ে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করেছে।
২০০০ সালে ডেনমার্কের সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ শিরোনামে প্রকল্পটি শুরু করে। প্রকল্পটি চতুর্থ পর্বে (২০১৬-২০২৩) বাস্তবায়ন হচ্ছিল। এ অবস্থায় দুই বছর আগে প্রকল্প থেকে সরে যায় ডেনমার্ক। অন্যদিকে কোভিডের সময় থেকেই প্রকল্পটি ব্যয় সংকোচনের মধ্যে পড়ে। তবে প্রকল্পের কর্মীদের প্রতিবাদের মুখে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি চালু রাখে। চতুর্থ পর্বে প্রকল্পটির তিন দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত ৩০ জুন প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়।
পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি ৩০ জুন শেষ হওয়ার আগে একই ধরনের কার্যক্রম নিয়ে নতুন প্রকল্প করার পরিকল্পনার কথা জানায় মন্ত্রণালয়। ঘোষিত সেই নতুন প্রকল্প পাসের আগে চলমান প্রকল্পটির কার্যক্রম আরও ছয় মাস চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জুলাই ও আগস্ট মাসে কাজ করেও বেতন পাননি প্রকল্পের কর্মীরা। এখন বরাদ্দ হওয়ায় কর্মীদের বেতন সমস্যা কাটল।
প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেট থেকে সমন্বয় করে অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন দিয়ে সরকারি অনুমোদন (জিও) জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৬ কোটি ৪০ টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর জারি করা জিও মন্ত্রণালয়ের হাতে এসেছে ৫ সেপ্টেম্বর। আরও কিছু প্রক্রিয়া অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে বকেয়া বেতনসহ নিয়মিত বেতন দেওয়া শুরু হবে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রকল্পের আওতায় ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, ৮টি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ৮টি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার-১০৯ এর আড়াই শর বেশি জনবলকে বেতন দেওয়া হবে।
বাজেট কমে যাওয়া, মাঝেমধ্যে বেতন বকেয়া থাকা, প্রকল্প থাকবে কি না—এ রকম নানা চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে প্রকল্পের কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। প্রকল্পে কর্মরত দুজন প্রথম আলোকে জানান, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাঁরা কাজ করেন। এখন নিজেদেরই ‘নির্যাতনের শিকার’ বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের প্রকল্পটি শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। নতুন প্রকল্পে জনবল নেওয়া হলে তাঁদের রাখা হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
প্রকল্পের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওসিসিতে তাঁরা নির্যাতনের শিকার নারীদের সেবা দিয়েছেন। কেউ পারিবারিক নির্যাতন, কেউ ধর্ষণের শিকার হয়ে এসেছিলেন। ৫ আগস্টের পর সারা দেশে যখন পুলিশের কার্যক্রম বন্ধ ছিল, তখন কেরানীগঞ্জ থেকে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীকে ওসিসিতে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা সেবা দিয়েছেন। তাই জরুরি এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এই প্রকল্পে মনোযোগ বাড়ানো উচিত।
এদিকে প্রকল্পটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, জনবলসহ প্রকল্পটিকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত করা হোক। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রকল্পের লোকজন রাজধানীর প্রেসক্লাবের সামনে এই দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (তখন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তাঁর হাতে ছিল, এখন উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন) ওই সময়ে এটাসহ অন্য প্রকল্পের বিষয়েও সারসংক্ষেপ চেয়েছিলেন। গত মাসে মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’, ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ প্রকল্পের’ বিষয়ে সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আলী ইমাম মজুমদারের কাছে দিয়ে আসেন।
এ প্রসঙ্গে যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘জনবলসহ কার্যক্রম রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের বিষয়ে আমরা আন্তরিক।’
নতুন প্রকল্পে আউটসোর্সিং হলে পুরোনো জনবল প্রকল্পে চাকরি পাবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্প প্রস্তাবে পুরোনো জনবল অগ্রাধিকার পাবে। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮ হওয়ার পর নতুন প্রকল্পের জন্য জনবল আউটসোর্সিং ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া যায় না। কিছু বিজ্ঞানবিষয়ক ও কারিগরি পদ রয়েছে, যা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিলে অসুবিধা হয়। এই প্রকল্পের কিছু পদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো নিয়ে কী করা যায়, তা দেখা হচ্ছে।