হাসমত আলী
হাসমত আলী

‘মানুষ আমার নামে ঘুড্ডি চিনে, আমারে চিনে না’

কাজ নিজের পরিচয় ছাপিয়ে গেলেই শিল্পীর তৃপ্তি। কিন্তু পুরান ঢাকার মো. হাসমত আলীর মন নিজের বানানো ঘুড়ি নিয়ে সব সময় অতৃপ্ত। তিনি পাল্লা দিতে চান বাতাসের সঙ্গে। তাঁর প্রতিযোগিতা মেশিনে তৈরি প্লাস্টিকের ঘুড়ির সঙ্গে। এসব কিছু ছাপিয়ে তিনি নিজের হাতে তৈরি করতে চান কাগজের নকশা করা নান্দনিক ঘুড়ি, যে ঘুড়িটি আকাশে উড়ে গেলেও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

বাংলাদেশ ঘুড়ি উৎসব, বিভিন্ন জায়গায় ঘুড়ি প্রতিযোগিতা, পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তির সাকরাইন উৎসবে যেসব রঙিন ঘুড়ি আকাশে ভাসতে থাকে, তার একটি অংশ তৈরি হয় মো. হাসমত আলীর হাতে। এমনকি বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক উৎসবে স্মারক হিসেবে যেসব ঘুড়ি পাঠানো হয়, সেখানেও গুরুত্ব পায় হাসমত আলীর ঘুড়ি। ৬৫ বছরের এই ঘুড়ির কারিগর ৫০ বছর ধরে ঘুড়ি বানাচ্ছেন। পুরান ঢাকার ঘুড়ি তৈরির কারিগরদের মধ্যে যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে প্রবীণ।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো. হাসমত আলী বাবার হাত ধরে ঘুড়ি বানানোর পেশায় আসেন
‘কারিগর দিয়া কাজ করানোর অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। আমার নীতি হইল—দাম হবে বেশি, তবে জিনিসটা দিব সবচেয়ে ভালো। হাসমতের বানানো ঘুড়ি খুঁত নিয়া আকাশে উইঠা উড়বে, এইটা হাসমত সজ্ঞানে সহ্য করবে না। কিন্তু কারিগরেরা ধুমধাড়াক্কা কাজ কইরা দিয়া দিবে, এ জন্য সব ঘুড়ি নিজের হাতে বানাই। ঘুড়ি বানানো আমার নেশা।’
হাসমত আলী

একাল-সেকালের ঘুড়ি নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে হাসমত আলী বলেন, ‘ঘুড়ির শখ না থাকলে নকশার গুরুত্ব বুঝবেন না। একটা চায়না বাক্স ঘুড়ি আর একটা চিলা ঘুড়ি আকাশে ওড়ানো এক কথা নয়। পাকিস্তান আমল থেকে আমি সাদাসিধা ঘুড়িতে নকশা বসানোর কাজ করছি। নকশা আবার শুধু হইলেই হইল না, ভারসাম্য রাখতে হবে। ওইটা নষ্ট হইলে ঘুড়ি উড়বে না।’

সাকরাইন উৎসবকে সামনে রেখে এখন মো. হাসমত আলীর ব্যস্ততা অনেক বেশি। এ বছর ১০ হাজারের বেশি ঘুড়ি তিনি বানিয়েছেন। তবে আগে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। এমনকি কোনো কোনো পৌষ সংক্রান্তিতে তিনি ৩০-৪০ হাজার ঘুড়িও বানিয়েছেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বাক্স ঘুড়ি, ইগল ঘুড়িসহ বাহারি নকশার ঘুড়ি তিনি বানানো শিখেছেন।

হাসমত আলীর নিজের কোনো দোকান নেই, কারখানা নেই, এমনকি সহযোগিতা করার জন্য কারিগরও নেই। প্রথম আলোকে হাসমত আলী বলেন, ‘কারিগর দিয়া কাজ করানোর অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। আমার নীতি হইল—দাম হবে বেশি, তবে জিনিসটা দিব সবচেয়ে ভালো। হাসমতের বানানো ঘুড়ি খুঁত নিয়া আকাশে উইঠা উড়বে, এইটা হাসমত সজ্ঞানে সহ্য করবে না। কিন্তু কারিগরেরা ধুমধাড়াক্কা কাজ কইরা দিয়া দিবে, এ জন্য সব ঘুড়ি নিজের হাতে বানাই। ঘুড়ি বানানো আমার নেশা।’

পুরান ঢাকার কলতাবাজারের হাজী আবদুল মজিদ লেনে নিজের বাড়িতে বসে ঘুড়ি বানান হাসমত আলী। বিভিন্ন দোকানদারেরা পাইকারি হিসেবে হাসমত আলীর কাছ থেকে ঘুড়ি কিনে নিয়ে যান। তবে এবার তিনি নির্দিষ্ট একটি দোকানে ঘুড়ি বিক্রি করেছেন। শাঁখারি বাজারের একটি দোকানে পাওয়া যাবে হাসমত আলীর ঘুড়ি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লার সব জায়গায় তিনি গণহারে ঘুড়ি বিক্রি করতে চান না। তিনি চান, যাঁরা ভালো ঘুড়ি চান, তাঁরা যেন কষ্ট করে শ্রম দিয়েই হাসমতের ঘুড়ি খুঁজে বের করেন। হাসমতের দাবি, তিনি কখনো নকশা নকল করেন না, বরং নতুন নতুন নকশা তৈরি করেন।

ঘুড়ি বানানোর কাঁচামাল কাগজ, মুলিবাঁশ, আঠা—সবই একসময় নয়াবাজারে পাওয়া যেত। এখন অনেক কিছুই আমদানি করতে হয়।

পুরান ঢাকাভিত্তিক সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকাইয়া জার্নালিস্ট ফোরামের আহ্বায়ক এ আই জাভেদ লালবাগের বাসিন্দা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ঢাকার ভালো ঘুড়ি মানে লালবাগ, দয়াগঞ্জ আর কলতাবাজারের তিনজন দক্ষ কারিগরের বানানো ঘুড়ি। এর মধ্যে দুজনই মারা গেছেন। আছেন শুধু কলতাবাজারের মো. হাসমত আলী। তাঁর নামেই ঘুড়ি বিক্রি হয়। এত ভালো ঘুড়িয়াল বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়জন নাই।’

পুরান ঢাকার কলতাবাজারের হাজী আবদুল মজিদ লেনে নিজের বাড়িতে বসে ঘুড়ি বানান হাসমত আলী। বিভিন্ন দোকানদারেরা পাইকারি হিসেবে হাসমত আলীর কাছ থেকে ঘুড়ি কিনে নিয়ে যান। তবে এবার তিনি নির্দিষ্ট একটি দোকানে ঘুড়ি বিক্রি করেছেন। শাঁখারি বাজারের এক দোকানে পাওয়া যাবে হাসমত আলীর ঘুড়ি।

মো. হাসমত আলীর বানানো ঘুড়ির মধ্যে আছে—চোকদার, টেক্কাদার, বেলুনদার। এসব হচ্ছে চারকোনা সাদামাটা ঘুড়ির ওপর কাগজ কেটে বসানো নকশা করা ঘুড়ি। তবে বিশেষ ঘুড়িও আছে হাসমত আলীর। সেসবের দাম, নাম—সবই ভারী।
হাসমত আলী নিজ হাতে সাদাসিধা নকশার ঘুড়ি দিনে ২০০টিও বানাতে পারেন। তবে জটিল নকশার একেকটা ঘুড়ি বানাতে দুই থেকে তিন দিন টানা কাজ করতে হয়। পৌষ সংক্রান্তির সময় তাঁর বানানো ঘুড়ির চাহিদা বাড়ে। তাঁর বানানো ঘুড়ি বাতাস কেটে শাঁই করে আকাশে উঠে যায় বলেই এত কদর। প্রথম আলোকে হাসমত আলী বলেন, এখন আনন্দ উৎসব বাড়লেও ঘুড়ির চাহিদা কমছে। এখন প্লাস্টিকের ঘুড়ি যেগুলো ভাঁজ করে রাখা যায়, সেগুলো আমদানি করা হয়। তাই কাগজের ঘুড়ির চাহিদা কম।
তবে হাসমত মনে করেন, কাগজ আর প্লাস্টিকের ঘুড়ির মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে, সেটা শুধু তারাই ভালো জানে, যারা ঘুড়ি ওড়ায়।

বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের সভাপতি শাহজাহান মৃধা বেণু প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসমত আলী কারিগর নন, তাঁকে আমি শিল্পী বলতে চাই। বহুদিনের অভিজ্ঞ শিল্পী। তাঁর হাতের কাজ ঐতিহ্যের স্বাক্ষর। বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনে দুই হাজারের মতো সদস্য আছে। এর মধ্যে কলতাবাজারের হাসমত আলী আমাদের খুব প্রিয় মানুষ। আফসোস হচ্ছে, আমরা নিজেরাই নিজেদের ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির খবর রাখি না। এর সঙ্গে জড়িত গুণীদের কদর করি না।’

উৎসবে যেসব রঙিন ঘুড়ি আকাশে ভাসতে থাকে, তার একটি অংশ তৈরি হয় মো. হাসমত আলীর হাতে

পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো. হাসমত আলী বাবার হাত ধরে ঘুড়ি বানানোর পেশায় আসেন। তাঁর বাবা আবদুল আলী ৪০ বছর ঘুড়ি বানিয়েছেন। বাবার কাজ দেখে শখের বশে ঘুড়ি বানাতে শুরু করেছিলেন হাসমত আলী। ঘুড়িয়াল মো. হাসমত আলীর মনে যেমন সৃষ্টির আনন্দ আছে, নকশার দক্ষতার গর্ব আছে, তেমনি অভিমানও আছে সমানভাবে। তিনি মনে করেন, সামনে পৌষ সংক্রান্তি বলে এখন তাঁর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সারা বছরে কেউ তাঁকে কখনো খুঁজে না বলে আক্ষেপ জানান তিনি।

২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সেন্ট মার্টিনে ঘুড়ি উৎসব করা হয়েছিল। তখন হাসমত আলীকে এক সপ্তাহের জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছ থেকে শেখার জন্য। এভাবে বিভিন্ন উৎসব হলে তাঁর খোঁজ নেওয়া হয়।

প্রথম আলোকে হাসমত আলী বলেন, ২০০৫ সালের ওই ঘুড়িগুলো ছিল প্যারাসুট কাপড়ের। সেসব ঘুড়ি ওড়ানোর কায়দা ছিল ভিন্ন। তাঁর বানানো ঘুড়ি চীন ও জাপানে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

সবশেষে এই ঘুড়িশিল্পী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অল্প বয়সীরা “হাসমতের ঘুড্ডি” বলতেই চিনে, কিন্তু হাসমত কে তা কেউ চিনে না। আমার কিন্তু তাতেই আনন্দ।’