পৌষের শেষ দিন। শনিবার সকালে পুরান ঢাকার আকাশটা ধুলামলিন, কুয়াশাচ্ছন্ন। তবু ছেলে-বুড়ো সবাই বাড়ির ছাদে হই-হুল্লোড়ে মত্ত। গলা ছাড়িয়ে বলছেন, ‘সুতা ছাড়, টান দে।’ কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা বাধা পেলেও আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি নজর এড়াল না। পৌষসংক্রান্তির এই দিন পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসব বা ঘুড়ি উৎসব হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, আগে শুধু ঘুড়ি উড়িয়ে আর ভালো-মন্দ খেয়ে উদ্যাপন করা হতো দিনটি। সময়ের ব্যবধানে এখন এসেছে অনেক পরিবর্তন। নানা নামে, নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি ডিজে পার্টি, আতশবাজি আর উচ্চ শব্দে গান বাজানো জায়গা করে নিয়েছে।
সরেজমিনে পুরান ঢাকার সদরঘাটের লক্ষ্মীবাজার, বংশাল, সূত্রাপুর, ওয়ারী, স্বামীবাগ, গোপীবাগ ও টিকাটুলী এলাকা ঘুরে দেখা গেল, কুয়াশাঢাকা আকাশেও উড়ছে নানা রঙের ঘুড়ি। আর কয়েক বাড়ি পরপর ছাদে বাজানো হচ্ছে উচ্চ শব্দে গান।
লক্ষ্মীবাজারের নবদ্বীপ বসাক লেনের বাসিন্দা রূপালী সরকার বললেন, ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি পৌষসংক্রান্তিতে তাঁরা পিঠা উৎসব করে থাকেন। এই উৎসবে সহপাঠীসহ আত্মীয়স্বজন বাসায় বেড়াতে আসেন।
শাঁখারীবাজারের একটি বাড়ির ছাদে দেখা হয় প্রপোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তৃষ্ণা সুর সঙ্গে। বাবা-চাচাদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল সে।
তৃষ্ণা প্রথম আলোকে বলল, ‘সাকরাইনের এই উপলক্ষ ছাড়া আসলে ঘুড়ি ওড়ানোর তেমন সময় পাওয়া যায় না। বাবা-চাচাদের থাকে ব্যবসার ব্যস্ততা আর আমাদের পড়াশোনা। বিকেলে ছাদে এসে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় হয় না। আজ সকাল থেকে আমরা ছাদে এসে ঘুড়ি ওড়াচ্ছি।’
ঘুড়ি কাটাকাটি খেলায় উচ্ছ্বসিত তৃষ্ণা বলল, ‘বাবা-চাচারা যখন ঘুড়ি ওড়ায়, আমরা পাশ থেকে দেখি। কোনো ঘুড়ি কেটে গেলে তা সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। আর মা-চাচিরাও আজ ভালো খাবার রান্না করছেন। অনেকে বাজি ফোটাচ্ছে। সবাই মিলে আনন্দ করছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী অশোক কুমার নন্দী প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমাদের বংশের অনেকে ঘুড়ি বিক্রি করেন এবং আগেও করতেন। একটা সময় ঘুড়ি বিক্রি করে কূল পাওয়া যেত না। এখন অনেকটা সময় ঘুড়ি নিয়ে বসে থাকতে হয়। সময়ের পরিবর্তনে এমন বদল এসেছে। তবু সাকরাইনের আগের দিন গতকাল শুক্রবার বেচাবিক্রি ভালো ছিল। আর আজ যা হবে তা–ই।’
শাঁখারীবাজারের রাধামাধব ভ্যারাইটিজ স্টোরে বছরজুড়ে বিক্রি হয় শাঁখা–সিঁদুর। তবে সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে এখন দোকানের স্বত্বাধিকারী রূপ কুমার নন্দী দোকানে উঠিয়েছেন ঘুড়ি, নাটাই। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, উৎসব উপলক্ষে ১০-১২ দিনে ঘুড়ি, নাটাই, সুতা ওঠানো হয়েছে। সাকরাইন সময়টাতে বেচাবিক্রি ভালো হয়।
কামরাঙ্গীরচর থেকে ঘুড়ি বানিয়ে তা সরবরাহ করতে এসেছিলেন মোহাম্মদ মাসুম। শুধু সাকরাইন উপলক্ষে এই ঘুড়ি বানানো হয় বলে জানালেন তিনি। মোহাম্মদ মাসুম বললেন, হাজার হাজার ঘুড়ি বানিয়ে তা বিভিন্ন দোকানে পাইকারি বিক্রি করা হয়। অনেক দোকানের অর্ডার নিয়ে কয়েক মাস আগ থেকে সরবরাহের কাজ করতে হয়।
শুধু দিনের বেলায় শেষ হচ্ছে না সাকরাইন উৎসবের আয়োজন। পুরান ঢাকার কয়েকটি বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখা যায়, ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। রয়েছে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। আছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। রাতের আকাশ আলোকিত হবে আতশবাজির বর্ণিল আলোয়।
সূত্রাপুরের কুমার মণ্ডল এমন আয়োজন করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, পুরান ঢাকার আশপাশ ও বাইরের বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছেন সাকরাইন উপলক্ষে। দিনে দিনে উৎসবটি ঢাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই এই আয়োজন।
একই গলিতে সমবয়সী কিছু তরুণ নিজেদের মধ্যে টাকা তুলে একটি বাড়ির ছাদে আলোকসজ্জা ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের একজন সৌমিক রায় বললেন, নিজেদের জমানো টাকা আর বড়দের থেকে কিছু নিয়ে এসব আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করতেই এই আয়োজন।