বাংলাদেশের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি পুরান ঢাকার ‘বড় কাটরা’র একটি অংশ আবারও ভাঙা হয়েছে। আদালতের আদেশ অমান্য করে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি বাড়ির সঙ্গে ভাঙা হয়েছে মুঘল আমলের এ স্থাপত্যের অংশবিশেষ। এখন ওই অংশটির কিছুই অবশিষ্ট নেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ওই বাড়িটি বড় কাটরার মূল অংশের ভেতরে অবস্থিত ছিল। বাড়িটির সঙ্গে যুক্ত ছিল বড় কাটরার একটি অংশ। ২০২২ সালেও বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু হয়েছিল। তখন বড় কাটরার অংশটিও কিছুটা ভাঙা পড়ে। তবে প্রতিবাদের মুখে তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বাড়ির মালিক। এরপর জায়গাটি সিলগালা করে দেয় সরকার।
বড় কাটরার ভেতরে ওই বাড়িটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। সিলগালা থাকা সত্ত্বেও গত আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাড়িটি আবার ভাঙার কাজ শুরু হয়। পুরোপুরি ভাঙা শেষ হয় ২৮ আগস্ট। রাজউকের পক্ষ থেকে এটি ‘আদালতের আদেশ অমান্য’ বলা হচ্ছে। এ ঘটনায় অভিযোগ জানিয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তবে বাড়ির মালিকের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে—কোনো অনিয়ম হয়নি।
২০২২ সালে আংশিক ভাঙা মুঘল স্থাপত্যের একাংশের বাকিটুকুও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবার। বড় কাটরায় অবস্থিত জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ভাঙার কাজ শুরু হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িটি ছিল বড় কাটরার দেয়ালের সঙ্গে। ওই দেয়ালে আনুমানিক প্রায় তিন শতাংশ জায়গা এবার নিশ্চিহ্ন করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের এ অংশে ছিল মুঘল আমলে বানানো তিনটি ঘর।
পুরান ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত বড় কাটরা। ধ্বংস হতে চলা এ স্থাপনার দেয়ালে এখনো দেখতে পাওয়া যায় ৪০০ বছর (১৬৪৪) আগের নকশার কাজ।
এ ঘটনায় গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িটা ছিল ব্রিটিশ আমলের। সেটি দেখে বোঝাই যায়নি যে ভেতরে মুঘল আমলে তৈরি দেয়াল আছে। ওই দেয়ালের একাংশের ওপর ভবনটি ছিল। এবার ভাঙা শেষে সবকিছু সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনার পরও জায়গাটি সিলগালা থাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। অন্য ভবনের ওপর থেকে সেখানকার ছবি নেওয়া হয়েছে।’
আফরোজা খান আরও বলেন, পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০ স্থাপনার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে—এসব স্থাপনার দেয়াল ভাঙা, সংস্কার, মেরামত করা যাবে না। তার মধ্যে বড় কাটরার ভেতরে নির্মাণ করা ওই বাড়িটিও ছিল। এ বিষয়ে ভবনের মালিক মো. আলী হোসেনের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কয়েক দফায় চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে। কিন্তু এবার তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়িসহ মুঘল আমলের স্থাপত্যের ওই অংশটুকু ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও স্থাপনা নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান আরবান স্টাডিজের কাছ থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, ২০২২ সালে সেখানে মুঘল স্থাপত্যের একটি অংশের আংশিক অবশিষ্ট ছিল। এবার সে অংশটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বলে অনুমিত ওই বাড়িটি বড় কাটরার সীমানার ভেতরে ছিল। বাড়িটি ভাঙার সময় মুঘল আমলের দেয়াল পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে বাড়ির মালিক মো. আলী হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁর মুঠোফোন সচল থাকলেও তিনি কথা বলেননি। তাঁর ছেলে মো. অনিক প্রথম আলোকে বলেন, এবার নতুন করে কিছু ভাঙা হয়নি। ২০২২ সালেই যা ভাঙার ভাঙা হয়েছে। আর এখানে তাঁদের ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন ছিল। সেটাই ভাঙা হয়েছে। সে ভবনটি মুঘল আমলের নয়।
পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০ স্থাপনার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে—এসব স্থাপনার দেয়াল ভাঙা, সংস্কার, মেরামত করা যাবে না। তার মধ্যে বড় কাটরার ভেতরে নির্মাণ করা ওই বাড়িটিও ছিল।
আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদের কাঠামোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন করা যাবে না। ভবনসংলগ্ন বা পাশে এবং চত্বরে নির্মাণ করা যাবে না নতুন কোনো স্থায়ী কাঠামো। কিন্তু দখলদারেরা এসব কিছুই না মেনে আদি কাঠামোর ওপর শুধু পরিবর্তন বা পরিবর্ধনই করছে না, নতুন নতুন কাঠামো নির্মাণ করে ঢেকে দিচ্ছে ভবনের মূল কাঠামো। বড় কাটরার ভেতরের চত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছুটা অংশ ছাড়া ভবন দুটির ভেতরের চত্বরও ঢাকা পড়ে গেছে নতুন নতুন ভবনে।
গত আগস্টে নতুন করে বড় কাটরার ভেতর এই বাড়ি ভাঙার বিষয়টি নিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন হলেও যেহেতু এটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা ছিল, ফলে মালিকপক্ষ এটি ভাঙতে পারে না। স্পষ্টই তিনি এটি অপরাধ করেছেন। এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুরান ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত বড় কাটরা। ধ্বংস হতে চলা এ স্থাপনার দেয়ালে এখনো দেখতে পাওয়া যায় ৪০০ বছর (১৬৪৪) আগের নকশার কাজ। সুবেদার শাহ সুজার আমলে বানানো বড় কাটরা ও সুবেদার শায়েস্তা খানের বানানো ছোট কাটরাকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯ সালে ‘সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করে। রাজউক এই দুই স্থাপনাকে ‘ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ভবন বা স্থাপনা’ হিসাবে ঘোষণা এবং সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করে ২০২০ সালে। এর আগে ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রথম এই স্থাপনাটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
আরবান স্টাডি গ্রুপ ২ হাজার ২০০টি বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছিল। এসব বাড়ি অক্ষত রেখে সেগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য নির্ণয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে ২০১৮ সালে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। মাঠপর্যায়ে জরিপ করে সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল ও নিষ্পত্তির আগে সেই ২ হাজার ২০০ স্থাপনায় কোনো রকম পরিবর্তন করা যাবে না বলে হাইকোর্ট আদেশ দেন। এই তালিকার মধ্যে আছে বড় কাটরা এবং ভেঙে ফেলা ওই বাড়িটিও।
আগে বড় কাটরার দক্ষিণ ও উত্তর বাহুর দৈর্ঘ্য ৬৭ দশমিক ৮৯ মিটার এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাহুর দৈর্ঘ্য ৬৯ দশমিক ৬৯ মিটার ছিল। আয়তাকার উন্মুক্ত চত্বর ঘিরে তৈরি এ ভবনের চারপাশে ছিল কক্ষ। সামনের দিকে ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে দুটি প্রধান প্রবেশপথ ছিল। এর মধ্যে দক্ষিণমুখী সুউচ্চ রাজকীয় প্রবেশদ্বার দূর থেকেই জানান দিত এ স্থাপত্যের অস্তিত্ব। তিনতলাবিশিষ্ট এই প্রবেশপথটি দূর থেকে নজর কাড়ত মানুষের। শৈল্পিকভাবেও এই মুঘল স্থাপত্যের সৌকর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থাপত্যের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বানানো হয়েছিল ছোট দুটি প্রবেশপথ। কিন্তু ক্রমশ দখল আর যখন-তখন এর বিভিন্ন অংশ ভেঙে ফেলায় এখন আর কিছুই বোঝার উপায় নেই।