৫২ হাজার এলইডি সড়কবাতির মধ্যে নষ্ট সাড়ে ৪ হাজার। মেরামতের উদ্যোগ নেই।
দুটি পৃথক প্রকল্পের আওতায় ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫২ হাজার এলইডি সড়কবাতি বসিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। প্রতিটি বাতি কিনতে ব্যয় হয়েছিল সাড়ে ৩৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। বাতিগুলোর ওয়ারেন্টি পিরিয়ড ছিল ১০ বছরের। কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে সাত মাস না যেতেই সাড়ে ৪ হাজার বাতি নষ্ট হয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে নষ্ট হওয়া বাতির সংখ্যা।
ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি ছিল, ১০ বছর তারা বাতি রক্ষণাবেক্ষণ করবে, নষ্ট হলে মেরামতও করে দেবে। কিন্তু ঠিকাদার চুক্তি অনুযায়ী কাজ করছে না। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে নষ্ট এলইডি বাতির নিচে কিছু এনার্জি (সিএফএল) বাতি বসিয়েছিল ডিএনসিসির বিদ্যুৎ শাখা। ওই বাতিগুলোও টেকেনি। এতে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকছে ডিএনসিসির বিভিন্ন সড়ক।
এ ধরনের কেনাকাটায় হঠাৎ করে একেকটা সিদ্ধান্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে কেনাও হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা থাকে না। এতে শুধু খরচ বাড়ে।আকতার মাহমুদ, নগর-পরিকল্পনাবিদ
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, প্রথমে ২০১৭ সালে পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার ৩৪৩টি এলইডি বাতি স্থাপন করা হয়। পরে ২০১৯ সালে আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ৪৮ হাজার ৮১২টি বাতি বসে। দুটি প্রকল্পে ব্যয় হয় ৩৫৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে, বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার বাতি নষ্ট। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের (১০ বছর) মধ্যে এসব বাতি নষ্ট হলেও বাতি মেরামত কিংবা প্রতিস্থাপনে ঠিকাদার কাজ করছে না। উল্টো নষ্টের দায় চাপানো হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ঘাড়ে।
প্রকল্প দুটির পরিচালক, বিদ্যুৎ শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের ভাষ্য, এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে দুই ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে আগেও একাধিক সভায় তারা বাতি মেরামতের আশ্বাস দিয়েছিল, কাজ করেনি।
ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে, বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার বাতি নষ্ট। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের (১০ বছর) মধ্যে এসব বাতি নষ্ট হলেও বাতি মেরামত কিংবা প্রতিস্থাপনে ঠিকাদার কাজ করছে না। উল্টো নষ্টের দায় চাপানো হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ঘাড়ে।
ডিএনসিসির বিদ্যুৎ শাখার সর্বশেষ হিসাবে ৪ হাজার ৪৭৯টি এলইডি সড়কবাতি নষ্ট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এর মধ্যে ৪ হাজার ৯৯টি নষ্ট বাতির দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। বাকি ৩৮০টির দায় সিটি করপোরেশনের।
নষ্ট বাতির মধ্যে ২০১৭ সালে কাজ শুরু হওয়া জার্মানির ভলকান কোম্পানির বাতি আছে ১ হাজার ১৮৩টি। প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ওই বাতি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে।
এ ছাড়া আরও ২ হাজার ৯১৬টি নষ্ট বাতি নেদারল্যান্ডসের ফিলিপস কোম্পানির। ২০১৯ সালে ওই বাতিগুলো লাগানোর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় গত বছরের জুনে। প্রকল্পটির পেছনে ব্যয় হয়েছিল ৩৩৪ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী দুই ঠিকাদারকে বন্ধ বাতি সচলের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঠিকাদারের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
দুটি প্রকল্পের আওতায় ডিএনসিসির ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অঞ্চলের আওতাধীন বিভিন্ন সড়কে বিভিন্ন ওয়াটের এলইডি সড়কবাতি স্থাপন করা হয়।
প্রথম প্রকল্পে কেনা বাতিগুলো ছিল ১২০ ও ১৫০ ওয়াটের। এর মধ্যে ১২০ ওয়াটের বাতির দাম ৪৩ হাজার টাকা। আর ১৫০ ওয়াটের দাম পড়ে ৪৭ হাজার টাকা। দ্বিতীয় প্রকল্পের অধীনে ৪০, ৬০, ৯০, ১২০ ও ১৫০ ওয়াটের বাতি কেনা হয়। তখন সবচেয়ে কম ওয়াটের (৪০ ওয়াটের) বাতি কিনতে লাগে ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা। সবচেয়ে বেশি ওয়াটের (১৫০ ওয়াট) বাতিতে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
প্রকৌশলীরা জানান, দুটি প্রকল্পের আওতায় কেনা বাতিগুলোর গড় দাম প্রায় ৪৩ হাজার টাকা। এই হিসাবে বর্তমানে নষ্ট থাকা বাতির জন্য ঢাকা উত্তর সিটির ব্যয় হয়েছে ১৭ কোটি ৬২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
চুক্তি অনুযায়ী দুই ঠিকাদারকে বন্ধ বাতি সচলের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঠিকাদারের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।বিদ্যুৎ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম মিয়া
ডিএনসিসির সূত্র বলছে, দুটি পৃথক প্রকল্পে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করেনি। জার্মানির ভলকান ও নেদারল্যান্ডসের ফিলিপস কোম্পানির তৈরি বাতিগুলো কেনা হয়েছে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে। যদিও যে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হয়েছে, তাদের কেউই এসব বাতি তৈরি করে না।
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া এভাবে কাজ দেওয়াটা আইনসম্মত হয়েছে কি না; সে বিষয়ে সিটি করপোরেশনের ওই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এবং ওই শাখার নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেননি।
বিষয়টি অবগত করা হলে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের পণ্য অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক উপায়ে কেনা উচিত। পুরো প্রক্রিয়াটাই অবৈধ হয়েছে, আইনসম্মতভাবে হয়নি।
এ ধরনের কেনাকাটায় হঠাৎ করে একেকটা সিদ্ধান্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে কেনাও হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা থাকে না। এতে শুধু খরচ বাড়ে। এখন সিটি করপোরেশন ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাতে পারছে না, নিজেও মেরামত করছে না। এতে কেবল জনভোগান্তিই বাড়ছে।নগর-পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ
দ্বিতীয় প্রকল্পে ৪৮ হাজার ৮১২টি বাতি স্থাপনের কাজ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছিল সহযোগী ঠিকাদার প্রোটোস্টার লিমিটেড। ডিএনসিসির প্রকৌশলীরা বলছেন, ওই ঠিকাদার কাজে অনিয়ম করার কারণেই এলইডি বাতিগুলো দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী তারা নষ্ট বাতিও ঠিক করছে না।
এ অবস্থায় নিজেদের দায়ে নষ্ট হওয়া ৩৮০টি বাতিসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ মেরামতে একটি দরপত্র চূড়ান্ত করেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। আর ছয় কোটি টাকার ওই কাজ পেয়েছে প্রোটোস্টার লিমিটেড।
বিষয়টিকে সুপরিচিত বাংলা প্রবাদ ‘সর্প হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো’র মতোই বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসিসির এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। তিনি বলেন, প্রোটোস্টার আরও ছয় কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিয়েছে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী প্রোটোস্টার নিজেদের দায়ভুক্ত বাতি ঠিক করে দিচ্ছে না। এই ঠিকাদারের মাঠপর্যায়ে সড়কবাতি রক্ষণাবেক্ষণের যান-যন্ত্রপাতি (হাইড্রোলিক গাড়ি) ও প্রশিক্ষিত জনবল নেই বলেও জানান তিনি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও নগর-পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কেনাকাটায় হঠাৎ করে একেকটা সিদ্ধান্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে কেনাও হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা থাকে না। এতে শুধু খরচ বাড়ে। এখন সিটি করপোরেশন ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাতে পারছে না, নিজেও মেরামত করছে না। এতে কেবল জনভোগান্তিই বাড়ছে।