ধানমন্ডি ২৭ নম্বরসহ ঢাকা দক্ষিণের ১০৯টি স্থানে ভারী বৃষ্টি হলেও যাতে জলাবদ্ধতা না হয়, সে জন্য গত চার বছরে খরচ করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা।
ভারী বৃষ্টি হলেই ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকার সড়ক ডুবে যেত। বহু বছরের এই সমস্যার সমাধানের জন্য তিন বছর আগে সেখানে ১৫ কোটি টাকা খরচ করে নতুন নর্দমা তৈরি করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এরপর ভাবা হয়েছিল ভারী বৃষ্টি হলেও আগের মতো পরিস্থিতি আর হবে না। কিন্তু গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় কোমরসমান পানি জমে যায়।
সর্বশেষ গত শুক্রবার (১২ জুলাই) সকালের ভারী বৃষ্টিতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকার সড়ক ডুবে যায়। সেদিন দুপুরে বৃষ্টি থামার ছয় ঘণ্টা পরও সেখানে ছিল থই থই পানি। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১০৯টি স্থানে ভারী বৃষ্টি হলেও যাতে জলাবদ্ধতা না হয়, সে জন্য গত চার বছরে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল নতুন নর্দমা নির্মাণ, পুরোনো নর্দমা সংস্কার, নর্দমা থেকে বর্জ্য অপসারণ, খাল খনন ও খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ। কিন্তু বিপুল টাকা খরচ করার পরও দেখা যাচ্ছে, ভারী বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হচ্ছেই।
প্রকৌশলগত সমাধানে নজর বেশি সিটি করপোরেশনের, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় তাদের নজর কম। সমন্বিত পরিকল্পনা না করে ঘষামাজা করে জলাবদ্ধতার মতো বড় সমস্যার সমাধান হয় না।অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, নগর-পরিকল্পনাবিদ
শহরের কোথাও বৃষ্টির পানি জমলে সাধারণত সেখানে নতুনভাবে নর্দমা তৈরি করে জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা করে সিটি করপোরেশন। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের এই চেষ্টা বিজ্ঞান ও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন প্রকৌশলী ও নগর-পরিকল্পনাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, বৃষ্টির পানি যথাযথভাবে নিষ্কাশন করতে হলে যেসব পথ হয়ে পানি বিভিন্ন জলাধার ও আশপাশের নদীতে গিয়ে পড়ে, সেখান থেকে কাজ শুরু করে ভেতরের দিকে আসতে হবে। ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের (যেভাবে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা কাজ করে) মধ্যে কোথাও পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে তা চিহ্নিত করে সেখানে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া ঢাকায় যেহেতু জলাধারের অভাব, তাই সবার আগে বিদ্যমান খালগুলো পুরোপুরি সচল রাখা জরুরি।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, শহরের ভেতরে পরিকল্পিত ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি না করে যেখানে পানি জমছে, শুধু সেখানে প্রকল্প নিয়ে জনগণের করের টাকা সিটি করপোরেশন খরচ করছে। আদতে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। দক্ষিণ সিটি চার বছর ধরে যে প্রক্রিয়ায় জলাবদ্ধতা সমাধানের চেষ্টা করছে, তা মূলত ‘টোটকা’ সমাধান। যে কারণে এখন আর এই ‘টোটকা’ কাজে আসছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানা যায়, আগে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকার পানি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও পান্থপথ মোড় হয়ে হাতিরঝিলে এসে পড়ত। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন সংযোগ তৈরি করে এই এলাকার পানি এখন সাতমসজিদ রোডে ঢাকা ওয়াসার পুরোনো একটি সংযোগের (পানিনিষ্কাশনের নর্দমা) সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা নব্বইয়ের দশকে ইট দিয়ে পানিনিষ্কাশনের ওই পথ তৈরি করেছিল।
তবে সাতমসজিদ রোডের যে অংশ দিয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের পানি নামার ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওই পথ পুরোপুরি সচল কি না, তা জানা নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকেরের কার্যালয়ে গিয়ে গতকাল তাঁর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকার বৃষ্টির পানি ওয়াসার ওই সংযোগ দিয়ে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর খালে গিয়ে পড়ে। তবে প্রবল বৃষ্টি হলে সংসদ ভবন এলাকার পানি ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় চলে আসে। তখন পানিনিষ্কাশনে সমস্যা হয়।
সংসদ ভবন এলাকা পড়েছে ঢাকা উত্তরে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে যে সমস্যার কথা ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেছেন, তা নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, সংসদ ভবন এলাকায় বর্ষা মৌসুমে জমে থাকা বৃষ্টির পানি সরাতে তিন বছর আগে নতুন সংযোগ পথ তৈরি করে তা শ্যামলীতে আরেকটি সংযোগের (পানিনিষ্কাশনের পথ) সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। বেশি বৃষ্টি হলে কিছু পানি ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে যেতে পারে। কারণ, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকা কিছুটা নিচু। দক্ষিণ সিটি নতুন পাইপ বসানোর সময় এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করলে হয়তো এই সমস্যা হতো না।
ধানমন্ডির পাশাপাশি পুরান ঢাকার আগাসাদেক রোড, আবুল হাসনাত রোড, কাজী আলাউদ্দিন রোড এলাকার বৃষ্টির পানি সরাতে ২০২১ সালে প্রকল্প নিয়ে ২০২২ সালে কাজ শেষ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। তবে এবার বর্ষা মৌসুমে দেখা গেল, ভারী বৃষ্টি হলে এসব এলাকাতেও জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীদের বর্তমান পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আগে নির্বিঘ্নে বুড়িগঙ্গা নদীতে পানি যাওয়ার পথ তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ পানি নামার পথ তৈরি না করেই জলাবদ্ধতা হয়, এমন জায়গায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুনভাবে নর্দমা করা হয়েছে।
বৃষ্টির পানি সরাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তিনটি প্রক্রিয়ায় কাজ করছে। প্রথমত, যেখানে পানি জমছে, সেখানেই নতুন নর্দমা তৈরি করছে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর বিদ্যমান নর্দমা পরিষ্কার করা। তৃতীয়ত, খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় কাউন্সিলরদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোথায় কোন নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে, তা ঠিক করা হয়। কাউন্সিলররা ধারণা থেকে নর্দমা পরিষ্কার করার তালিকা দেন। এই কাজে সিটি করপোরেশন প্রতিবছর গড়ে ১৮ কোটি টাকা খরচ করে।
তবে নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নর্দমায় বর্জ্য জমেছে, এই কাজ ধারণা থেকে করা যুক্তিসংগত হতে পারে না। সিটি করপোরেশন এভাবে কাজ করে থাকলে এটি বন্ধ করা উচিত। কোন কোন নর্দমা ভরাট হয়ে গেছে, তা যাচাই (কারিগরি দিক বিবেচনায় নেওয়া) করে কাজ করা উচিত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ খাল পুরোপুরি সচল না থাকা। দক্ষিণ সিটিতে এখন খাল আছে ১৫টি। এর মধ্যে প্রতিবছর ১১টি ছোট-বড় খাল থেকে বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হয়। তবে মূল যে চারটি খাল (শ্যামপুর, মান্ডা, কালুনগর ও জিরানী) পরিষ্কার করে নাব্যতা ফেরানো দরকার, সেই কাজ তিন বছর ধরে বন্ধ আছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ওই চার খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ তৈরিতে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের ২১ মাস পরও পুরোপুরিভাবে কাজ শুরু হয়নি।
এই প্রকল্পের পরিচালক খায়রুল বাকের জানান, খালের সীমানা নির্ধারণের কাজটি অনেক জটিল। এই কাজ তাঁরা আগে করেছেন। এরপর খাল উদ্ধারের কিছু কাজ শুরু হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে তিন বছর আগে খাল ও নালার দায়িত্ব বুঝে নেয় দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু ওয়াসার কাছ থেকে যন্ত্রপাতি ও জনবল (ড্রেনেজ সার্কেল) বুঝে নেয়নি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ওয়াসার কাছ থেকে দক্ষ জনবল না নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জনবল নিয়োগের চাহিদা দিয়ে রেখেছে তারা। এখনো জনবল নিয়োগের অনুমতি পায়নি তারা। ফলে জোড়াতালি দিয়ে খাল ও নালা রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি হচ্ছে। যার পরিণতি হচ্ছে ভারী বৃষ্টি হলেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন এলাকার সড়ক ডুবে থাকছে।
ভারী বৃষ্টিতে গত শুক্রবার ছাড়াও চলতি বছরের ১১ ও ২৭ মে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। এর মধ্যে শুক্রবার দুপুরে বৃষ্টি থামার ৩০ ঘণ্টা পরও পুরান ঢাকার বকশীবাজার, চকবাজার, চানখাঁরপুল, হোসেনি দালান, বুয়েট ক্যাম্পাস ও স্বামীবাগ এলাকার বেশির ভাগ সড়কে হাঁটুসমান বা এর কাছাকাছি পরিমাণ পানি ছিল।
নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় এমনিতে প্রাকৃতিক জলাধারের খুবই অভাব। যে কারণে দক্ষিণ সিটির মূল কাজ হওয়া উচিত ছিল কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক নর্দমার আন্তসংযোগ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, আগে সেই পরিকল্পনা করা। এটি না করে বিচ্ছিন্নভাবে শত শত কোটি টাকা খরচ করায় কার্যত কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকৌশলগত সমাধানে নজর বেশি সিটি করপোরেশনের, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় তাদের নজর কম। সমন্বিত পরিকল্পনা না করে ঘষামাজা করে জলাবদ্ধতার মতো বড় সমস্যার সমাধান হয় না।