ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও এর কাছের তিন কিলোমিটার মহাসড়ককে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে ১ অক্টোবর এ ঘোষণা আসে। ঘোষণার পরপর কিছুটা কমেছিল শব্দদূষণ। ঘোষিত সেই নীরব এলাকার মধ্যে চার স্থানের শব্দ পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, দুই স্থানে শব্দ কিছুটা কমেছে। কিন্তু দুই স্থানে আবার বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বায়ুদূষণে বিশ্বের দূষিত নগরীগুলোর মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে থাকে ঢাকা। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের বছরভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ। আর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ১ নম্বরে ছিল ভারতের নয়াদিল্লি। এরপর ছিল ঢাকা। বায়ুর দূষণে নাকাল এ নগরে শব্দদূষণও ব্যাপক।
চিকিৎসকেরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ নানা রোগ বাড়ছে রাজধানীতে। আর শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, বধিরতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কম ঘুম হওয়া, হৃদ্রোগ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্ন হওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। স্বল্পমেয়াদি শব্দদূষণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি শব্দদূষণ শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা, রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিহার, ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্মৃতিশক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা কমে যায়।
অনেকেই শব্দদূষণকে ‘শব্দ–সন্ত্রাস’ বলে থাকেন। এ দূষণ রোধে নীরব এলাকা ঘোষণার তৎপরতাও নতুন নয়। এর ধারাবাহিকতায় নতুন করে বিমানবন্দর এলাকা ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। তবে তাতে ভালো ফল মেলেনি।
তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আশাবাদী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা শুরু মাত্র। এত দ্রুত ফল পাওয়া যাবে, তা আশা করা ঠিক না। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকটাই সচেতনতা বেড়েছে।
শব্দদূষণ একটি গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে বাংলাদেশে চিহ্নিত। বিশেষ করে ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকায় শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। শব্দের প্রধান উৎস যানবাহন। এর হর্ন, ইঞ্জিন ও চাকার কম্পন মূলত দূষণের জন্য বেশি দায়ী। এ ছাড়া আছে নির্মাণকাজ বা ইট ও পাথর ভাঙার শব্দ, কলকারখানা, জেনারেটর এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাইকিং।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় দিনের সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতের ৪৫ ডেসিবেল সহনীয়। আর বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের ৭০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় দিনের ৭৫ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের আদর্শ মান দিনের ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতের ৪০ ডেসিবেল। এ সংস্থা বলছে, অতিরিক্ত শব্দ হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ১ অক্টোবর থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দেড় কিলোমিটার উত্তর থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ পর্যন্ত মোট ৩ কিলোমিটার এলাকা ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করে। এতে সহযোগিতা করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
এর আগেও ২০১৯ সালে সচিবালয় এলাকা, শিশুমেলা, গণভবন, বিজয় সরণি, স্পারসো, রোকেয়া সরণি, পরিসংখ্যান ভবনের সম্মুখে, শহীদ শাহাবুদ্দিন সড়ক ও বীর উত্তম খালেদ মোশাররফ অ্যাভিনিউকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
বিমানবন্দর এলাকা নীরব এলাকা ঘোষণা করার আগে ও পরে শব্দদূষণের কি তারতম্য হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটি স্বয়ংক্রিয় সাউন্ড লেভেল মিটারের সাহায্যে শব্দদূষণ পরিমাপ করে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর–সংলগ্ন এলাকা নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা কার্যকর হওয়ার আগের ৫ দিন (২৬ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু করে ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পরের ৫ দিন পর্যন্ত (৩০ সেপ্টেম্বর) বিমানবন্দর এলাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে প্রথমবার শব্দদূষণের ডেটা সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২৮ নভেম্বর ও ২ থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৃথক ৫ দিনে দ্বিতীয়বার একই স্থানে শব্দদূষণের উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। ১০ সদস্যের একটি গবেষণা দল বিমানবন্দর–সংলগ্ন ৪টি স্থান থেকে গবেষণা উপাত্ত সংগ্রহ করে। এলাকাগুলো হলো বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথ, অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথ, স্কলাস্টিকা স্কুল এবং লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনের অংশ।
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকা কার্যকরের আগের পাঁচ দিনের গড় শব্দমাত্রা ছিল ৮৭ দশমিক ৮১ ডেসিবেল। নীরব এলাকা কার্যকর হওয়ার পরবর্তী ৫ দিনে এটি কমে ৮৬ দশমিক ৪৯ ডেসিবেল হয়, অর্থাৎ প্রথম পাঁচ দিন ১ দশমিক ৩৩ ডেসিবেল বা দেড় শতাংশ শব্দদূষণ কমেছে। দুই মাস পর শব্দমাত্রা কার্যকরের আগের পাঁচ দিনের চেয়ে শূন্য দশমিক ৫১ ডেসিবেল কমেছে। কিন্তু কার্যকরের আগের পাঁচ দিনের তুলনায় দুই মাস পর দূষণ প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে গেছে।
নীরব এলাকা কার্যকরের পরবর্তী পাঁচ দিনে লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনে ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ এবং স্কলাস্টিকা ক্যাম্পাসে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ শব্দদূষণ কমেছে। নীরব এলাকা কার্যকরের পরবর্তী পাঁচ দিনে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথে ১ দশমিক ১৯ শতাংশ শব্দদূষণ বেড়েছে। দুই মাস পর লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনে শব্দদূষণ ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং স্কলাস্টিকা স্কুল পয়েন্টে ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। তবে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথে ২ দশমিক ৯৭ শতাংশ শব্দদূষণ বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে কার্যকরের পর প্রথম ধাপে শব্দদূষণ কমলেও দ্বিতীয় ধাপে প্রথম ধাপের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে গেছে।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ভালো উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু শব্দদূষণ–সম্পর্কিত সচেতনতামূলক প্রচারের অভাব ছিল। যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের নীরব এলাকা সম্পর্কে যথাযথভাবে জানানো হয়নি। আবার কিছু অবকাঠামোগত সমস্যা আছে। যেমন বিমানবন্দর এলাকায় বাসস্ট্যান্ডের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। বিমানবন্দরের মূল ফটকের সামনে ইউটার্নের কারণে সৃষ্ট যানজটে শব্দদূষণ বেশি হয়। নীরব এলাকা চিহ্নিত করতে রাস্তার রঙের পরিবর্তন করলে চালক ও যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে।
বিমানবন্দরে শব্দদূষণ না কমার পেছনে প্রচারের অভাব ছিল—এমন অভিযোগের বিষয়ে একমত পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা) সৈয়দা মাছুমা খানম। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কাজ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। এর দেখভাল করেন সৈয়দা মাছুমা খানম। তিনি বলেন, প্রচারের কোনো ঘাটতি ছিল না। চালকদেরও সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচিতে নেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দরের নীরব এলাকা ঘোষণার পর ‘সীমিত সাফল্যের’ বিষয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মন্তব্য, এবারের নীরব এলাকা ঘোষণায় অনেকটা সাড়া পড়েছে। একে নেতিবাচকভাবে দেখার কিছু নেই।
দুটি প্রক্রিয়া শব্দদূষণ কমাতে সহায়ক বলে মনে করেন রিজওয়ানা হাসান। এর মধ্যে একটি হলো সচেতনতা বাড়ানো, আরেকটি আইনের যথাযথ প্রয়োগ। তিনি বলেন, শব্দদূষণ বিধিমালায় দূষণের শাস্তির বিধান নেই। বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। সেখানে পুলিশের প্রস্তাব আছে, হর্ন বাজানো বন্ধে তাৎক্ষণিক মামলার ক্ষমতা তাদের দিতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে।
নীরব এলাকা ঘোষণা করার পরও কেন এলাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শব্দদূষণ কমে না? এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন না এলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কেউ হর্ন দেয় না। কারণ, সেখানে নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু বিমানবন্দর এলাকায় যত্রতত্র যানবাহন চলাচলে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই ট্রাফিকের। এমন অবস্থা নগরীর অন্যান্য সড়কেও।’