তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকদের কোনো ধরনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে অবৈধভাবে থাকছে—এ কথা বলে উচ্ছেদ করে দেওয়া অবশ্যই মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ধলপুরে তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকদের আবাসস্থল পরিদর্শনের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের দেশে সামাজিক নানা কুসংস্কারের কারণে তাদের অন্য কোথাও গিয়ে থাকার উপায় নেই। এই লোকগুলো যাবে কোথায় তাহলে? তারা তো বাংলাদেশের নাগরিক! আমি মনে করি, উচ্ছেদের আগে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে তাদের ধর্মীয় প্রার্থনাস্থল রয়েছে তিনটি। একটি মন্দির রয়েছে। দুটি গির্জা রয়েছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ কোনো উদ্যোগ নিলে এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কী ব্যবস্থা হবে। এগুলো কিন্তু যাঁরা উচ্ছেদ করছেন, তাঁদের গভীরভাবে চিন্তা করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।’
যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে প্রায় ১৫ একর জায়গায় ঘরবাড়ি স্থাপন করে বিভিন্ন মানুষ বসবাস করে আসছিলেন। এসব মানুষের মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ছিলেন। তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকজনও এখানে বসবাস করতেন।
ধলপুরের এ জায়গা অনেকের কাছে ‘মেথর পট্টি’ নামে পরিচিত। এ এলাকায় দক্ষিণ সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে যারা তেলেগু সম্প্রদায় রয়েছে, তাদের থাকার জন্য কয়েক বছর আগেই দুটি ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। ওই সব ভবনের বাইরেও অন্তত ১ হাজার ৩০০ লোক এ জায়গায় বসবাস করছেন। এই লোকদের উচ্ছেদ করতেই দক্ষিণ সিটি চেষ্টা চালিয়েছিল।
গত রোববার এখানে উচ্ছেদে অভিযান চালিয়ে এ এলাকায় গড়ে ওঠা অন্তত ১০টা বস্তি উচ্ছেদ করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সে সময় তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকদের বাসাবাড়ি উচ্ছেদ করতে গেলে তাঁরা বাধা দেন। প্রতিবাদের মুখে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন পর্যন্ত এ সম্প্রদায়ের লোকদের উচ্ছেদ করেনি। তবে এ সম্প্রদায়ের লোকজন বেশ আতঙ্কে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে গত রোববার থেকেই বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা ধলপুরে সরেজমিন পরিদর্শন করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে তেলেগু সম্প্রদায়ের অবস্থা দেখতে সরেজমিনে এসেছেন।
গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, জীবিকার অধিকার—এগুলো সবই মানবাধিকার। এগুলো আমাদের সংবিধান স্বীকৃত। আলোচনা উঠেছে, একটি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তা দেখতেই সরেজমিনে এসেছি। নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করার সমীচীন নয়। এ জন্য আমার সহকর্মীদের নিয়ে দেখতে এসেছি।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যাঁরা এখানে বসবাস করছেন, তাঁদের ১৯৯০ সালে থাকার জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। তবে হঠাৎই কোনো ধরনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে এভাবে উচ্ছেদ করলে অবশ্যই তাদের জন্য এটি ভীষণ কষ্টের একটি বিষয় হবে। তারা যাবে কোথায়? আমি যতটুকু দেখেছি, এখানে তারা ছোট্ট পরিসরে গাদাগাদি করে থাকে। এ অবস্থায় এই লোকগুলোর অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে বিষয়টি গভীর উদ্যোগের সঙ্গে দেখা হচ্ছে জানিয়ে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ধরনের উচ্ছেদই সমীচীন নয়। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অবশ্যই করা উচিত। তাদের ধর্ম পালনের অধিকার আছে। সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। তাদের শিক্ষার অধিকার আছে। সেই ব্যবস্থাও করে দেওয়া উচিত।
সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসবেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা রয়েছে। বিচারিক ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সুবাদে আমরা যা করার করব। সুপারিশগুলো নিশ্চিতভাবেই এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে।’
তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকেরা বেশ আতঙ্কে রয়েছেন। তাঁদের আশ্বস্ত করার কোনো সুযোগ রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ বন্ধ করেছে কি না, বিষয়টি আমাদের জানতে হবে। আমরা আমাদের দাপ্তরিক নিয়মে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব, বিষয়টি দেখব। যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক তারা, সেহেতু তাদের এখানে থাকার অধিকার রয়েছে। তাদের মানসিক শক্তি ধারণ করা উচিত যে কর্তৃপক্ষ যথাযথ একটা ব্যবস্থা নেবে। সেই প্রচেষ্টা আমরাও করব, যাতে তাদের আবাসনের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’
এর আগে পৌনে ১১টার দিকে ধলপুরে এসে পৌঁছান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তাঁকে পেয়ে তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা বলতে থাকেন, ‘আমাদের যাওয়ার জায়গা নাই। দয়া করে আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিন।’ তেলেগু সম্প্রদায়ের অনেক বাসিন্দা মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পায়ে লুটিয়ে পড়েন।
পরে তেলেগু সম্প্রদায়ের লোকদের আবাসস্থল পরিদর্শন করেন কমিশনের চেয়ারম্যান। এ সময় তিনি এ সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলেন, কুশলাদি বিনিময় করেন। পরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এ সময় কমিশনারের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য সেলিম রেজা, পরিচালক কাজী আরফান আশিক, উপপরিচালক পরিচালক সুস্মিতা পাইক, ফারহানা সাঈদ প্রমুখ।