প্রয়োজন নেই, তবু ঢাকা দক্ষিণ সিটির জিরানীসহ চার খালে সেতুসহ বিপুল ব্যয়ে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় জিরানী খালে গাড়ি চলাচলের দুটি সেতু ও মানুষের চলাচলের চারটি পদচারী–সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। একই খালের পাশে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি। অথচ জিরানী খালে আগে থেকেই ১৩টি সেতু রয়েছে। এই খালে নতুন করে সেতু নির্মাণের দরকার নেই। আবার ওয়াকওয়ে করার মতো কোনো জায়গাও নেই। ছয় সেতুসহ জিরানী খাল সংস্কার ও পুনরুদ্ধারে ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি।
একইভাবে রাজধানীর মান্ডা, শ্যামপুর ও কালুনগর খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার, সেতু নির্মাণ ও নান্দনিকভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। সংস্থাটির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই চার খালের উন্নয়নে ২০২০ সালের অক্টোবরে সব মিলিয়ে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন। এই চার খাল হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার পানি আশপাশের নদ–নদীতে গিয়ে পড়ে।
অভিযোগ উঠেছে, মাঠপর্যায়ে কোনো সমীক্ষা না করে ঘরে বসে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে ক্ষমতার জোরে প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করোপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। খালগুলোয় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ দলের নেতা–কর্মী ও অনুগত ব্যক্তিদের দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর।
নগর–পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, খাল ও এর আশপাশে কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরির চেয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু করপোরেশন সে কাজে গুরুত্ব কম দিয়ে অর্থের অপচয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।
অভিযোগ উঠেছে, মাঠপর্যায়ে কোনো সমীক্ষা না করে ঘরে বসে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে ক্ষমতার জোরে প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করোপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। খালগুলোয় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ দলের নেতা–কর্মী ও অনুগত ব্যক্তিদের দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি পর্যালোচনা করা হবে। এর মধ্যে অযৌক্তিক কোনো প্রস্তাব বা পরিকল্পনা থাকলে তা বাতিল করা হবে। রাষ্ট্রের অর্থের যাতে অপচয় না হয়, সে বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। প্রশ্ন ওঠায় ইতিমধ্যে আগের প্রকল্প পরিচালককে বাদ নিয়ে নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কেবল সেতু নয়, এই প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় নানা অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষের মতামত না নিয়ে এই প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল।
প্রয়োজন ছাড়াই ৫৭ সেতু
এই প্রকল্পের আওতায় জিরানী খালে গাড়ি ও মানুষ চলাচলের ৬টি, মান্ডা খালে গাড়ি চলাচলের ৬টি ও মানুষ চলাচলের ২২টি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। এ ছাড়া শ্যামপুর খালে ৯টি গাড়ি চলাচলের সেতু ও ৬টি পদচারী–সেতু এবং কালুনগর খালে ৪টি গাড়ি চলাচলের সেতু ও ৪টি পদচারী–সেতু নির্মাণ করতে চায় সংস্থাটি। এই ৫৭ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কেবল সেতু নয়, এই প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় নানা অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষের মতামত না নিয়ে এই প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল।
মান্ডা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সময়ে মান্ডা খালের পাশে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে সেতু নির্মাণ করেছেন। এই খালে নতুন করে ২৮টি সেতু নির্মাণের প্রয়োজন নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটির আরেক প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, কালুনগর খালে আটটি সেতু নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় মানুষেরও চাহিদা নেই।
এর আগে ২০২১ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি একটি প্রকল্পের আওতায় মান্ডার শেষ মাথা এলাকায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু করেছিল। সেতুটির পর আর সড়ক না থাকায় সেটি সাড়ে তিন বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ওই প্রকল্পের আওতায় জিরানী খালেও এমন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সেতুর অন্য প্রান্তে রাস্তা না থাকায় নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এখন সেই জিরানী খালেই আরও ছয়টি সেতু নির্মাণ করতে চাচ্ছে সিটি করপোরেশন।
একইভাবে ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য মান্ডা খালে ৩৯ কোটি ৫৭ লাখ, শ্যামপুর খালে প্রায় ১০ কোটি এবং কালুনগর খালে সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ওয়াকওয়েরও জায়গা নেই
জিরানী খালের এক পাশে বড় সড়ক, অন্য পাশে মানুষের বসতি। এ অবস্থায় সেখানে ওয়াকওয়ে করার কোনো জায়গা নেই। অথচ এই প্রকল্পে জিরানীর পাশে ওয়াকওয়ে তৈরির পরিকল্পনা করছে দক্ষিণ সিটি। একইভাবে ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য মান্ডা খালে ৩৯ কোটি ৫৭ লাখ, শ্যামপুর খালে প্রায় ১০ কোটি এবং কালুনগর খালে সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আরও যত বাড়তি ব্যয়
প্রকল্পের আওতায় ৪টি খালে ৭৭১টি বিদ্যুতের খুঁটি বসাতে ৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রতিটি খুঁটি বসাতে খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্থাটি অন্যান্য এলাকায় যেসব খুঁটি বসিয়েছে, তাতে প্রতিটিতে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
এ ছাড়া তিনটি খালের পাশে খাবারের দোকান বানাতে ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে দক্ষিণ সিটি। খাল থেকে ময়লা ও পলি অপসারণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৩ কোটি টাকা। অথচ ২০২১ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি একই কাজে ব্যয় করেছে মাত্র দেড় কোটি টাকা।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এবার বেশি পলি অপসারণ করা হবে। তাই ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে।
তবে সিটির প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রবহমান নদ–নদী বা খালে পলি অপসারণের কাজটি রুটিনমাফিক। দেড় কোটি টাকার কাজ ৩৩ কোটি টাকায় কেন করার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত হতে পারে।
এই প্রকল্পের পুরো কাজটি করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রকল্পের দায়িত্বে তিনি নন, অন্য একজন আছেন। অপ্রয়োজনীয় পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁরা যেভাবে খালের সংস্কার করতে চান, সেভাবে করলে এসব অবকাঠামো লাগবে।
সবাইকে দায় নিতে হবে
নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, কম ব্যয়ে যে কাজ করা যাবে, সেটি কয়েক গুণ খরচ বৃদ্ধির একটাই লক্ষ্য—পকেট ভারী করা। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে করতে পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়েছে যে জলাবদ্ধতার কারণে মানুষের এত দুর্ভোগ হলেও তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ভ্রুক্ষেপ নেই। কেবল মেয়রকে দোষারোপ করলেই হবে না, এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সবাইকে দায় নিতে হবে। তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।