ছয় মাসে ডেঙ্গুর এমন রূপ দেখেনি দেশ

ডেঙ্গুতে গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছিল দেশ। সে বছরও প্রথম ছয় মাসে মৃত্যু হয়েছিল একজনের। এবার ইতিমধ্যে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ডেঙ্গু মশা
ফাইল ছবি

চলতি বছর প্রথম ছয় মাস পেরোনোর আগেই ডেঙ্গু জ্বরে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৭৫৪ জন। দেশে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য–উপাত্ত বলছে, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হন। ওই বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল আটজনের। আর গত বছর (২০২২) দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়। গত বছরও প্রথম ছয় মাসে মৃত্যু হয়েছিল একজনের।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অন্য সব বছরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যাও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মহামারিতে যেমন তৎপরতা নেওয়া হয়ে থাকে, তেমন করে প্রস্তুতির তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন ডেঙ্গুবাহিত জ্বরটি ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিত ছিল। এরপর বিভিন্ন সময় কিছু ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে বেশ কিছু ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিল।

মহামারি রোধে যে প্রস্তুতি নিতে হয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবার তেমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস মাশাবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়ে যায়। সে বছর দেশে ৫ হাজার ৫৫১ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। আর সে বছর এডিস মশাবাহিত এ রোগে মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। ২০০০ সালের পর প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে সব বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়নি। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল—এই চার বছর এবং ২০১৪ সালে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি।

২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এরপর দেশের সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় গত বছর (২০২২)। আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মারা যান ২৮১ জন। এটি ছিল দেশে যেকোনো বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু।

গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে ৭ হাজার ৭৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের এর আগের সর্বোচ্চ সংক্রমণের বছর ২০১৯ সালে প্রথম ছয় মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২০৮ জন। গত বছর প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ হাজার ৮৯ জন।

* ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন ডেঙ্গুবাহিত জ্বরটি ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিত ছিল। * ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে বেশ কিছু ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিল।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দেশে সাধারণত জুনের পর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তাই আগামী দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’

গত বর্ষার ভরা মৌসুমে যত বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে, এবার প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে তার চেয়ে বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। গত চার–পাঁচ বছরে এত বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম

পরিস্থিতি খারাপের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপের ফল। ঢাকায় বসতবাড়িতে এবার প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমেই এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। গত বর্ষা মৌসুমের তুলনায় ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেশি বাড়িতে লার্ভা পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বর্ষার ভরা মৌসুমে যত বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে, এবার প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে তার চেয়ে বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। গত চার–পাঁচ বছরে এত বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়নি।’

জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘মহামারি রোধে যে প্রস্তুতি নিতে হয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবার তেমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।’