দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ

শুভাঢ্যা খালের কিছু অংশ হেঁটেও পার হওয়া যায়

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা খাল এখন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে রয়েছে। গত শুক্রবার খালের কালীগঞ্জ এলাকায়।
ছবি: দীপু মালাকার

এক দশক আগেও ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা মধ্যপাড়া থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত নৌকায় যাতায়াত করতে পারতেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দিন বদলেছে, এখন চাইলে শুভাঢ্যা খালের কিছু অংশ হেঁটেই পার হওয়া যায়! আবর্জনার স্তূপ জমে খালের প্রায় অর্ধেকটা ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দখলদারদের থাবাও পড়েছে।

শুভাঢ্যা খালের দৈর্ঘ্য সাত কিলোমিটার। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা এই খাল ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর কালীগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে রাজেন্দ্রপুর বাজার এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে। কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ও তেঘরিয়া—এই দুই ইউনিয়নের ওপর দিয়ে গেছে এই খাল।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই খাল দখলমুক্ত ও বর্জ্য অপসারণের কাজ করেছিল স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু এসব উদ্যোগ স্থায়ীভাবে কাজে আসেনি। ১৬ বছর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খাল পুনরুদ্ধারে বড় ধরনের অভিযান চালানো হয়েছিল। তখন এই খালে পানির প্রবাহ ফিরে এসেছিল। কিন্তু চার–পাঁচ বছর পর পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় চলে যায়।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা বড় পরিসরে প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। সে সময় খালের প্রায় তিন কিলোমিটার অংশে ১৮৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর খালে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়। তবে কয়েক বছর পর খালটি আবার ভরাট হতে থাকে।

শুভাঢ্যা মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবদুল মতিন খানের সঙ্গে কথা হয় গত শুক্রবার দুপুরে। খালের পাড়েই তাঁর বাড়ি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ সালেও খালটি ব্যবহারের উপযোগী ছিল। তিনি নিজে নৌকায় করে কালীগঞ্জে গিয়েছেন। তখন অনেকে এই খালেই নিয়মিত গোসল করাতেন। শুভাঢ্যা উত্তর ও মধ্যপাড়া জামে মসজিদে আগত মুসল্লিরা এই খালের পানি দিয়েই অজু করতেন। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে যতবার এই খালের বর্জ্য অপসারণ ও খননের কাজ হয়েছে, ততবার সব বর্জ্য ও মাটি খালের পাড়ে রেখে দেওয়া হয়েছিল। বৃষ্টির পানিতে এসব বর্জ্য ও মাটি আবার খালে গিয়ে পড়েছে।

প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শুভাঢ্যা খালের চর কালীগঞ্জ, কালীগঞ্জ বাজার, জোড়া ব্রিজ, নয়া শুভাঢ্যা, কদমতলী, চরকুতুব, ঝাউবাড়ি, বেগুনবাড়ি ও গোলামবাজার অংশ ঘুরে দেখেন। খালের এসব অংশে দেখা গেছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। চর কালীগঞ্জ থেকে গোলামবাজার পর্যন্ত অংশে অনেক জায়গায় লোকজনকে হেঁটেই খাল পার হতে দেখা যায়। তবে খালের গোলামবাজার অংশ থেকে রাজেন্দ্রপুর হয়ে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত কিছুটা পানি রয়েছে। তবে খালের এই অংশও পুরোটা কচুরিপানায় ঢাকা।

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে শুভাঢ্যা খালের নাব্যতা রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা জেলা প্রশাসন। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে খালপাড়ে তখন এক অনুষ্ঠানে ঢাকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, শুভাঢ্যা খাল একসময় কেরানীগঞ্জের মানুষের গর্ব ছিল। এটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ খালে পরিণত হয়েছে। তাই এই খাল কেরানীগঞ্জবাসীর জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো

গত শুক্রবার খালের জোড়া ব্রিজ এলাকার কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মালেকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খাল দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে এ অবস্থা হতো না।

খালে পানিপ্রবাহ বন্ধ থাকার কারণে ভারী বৃষ্টি হলে শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়া ও ঘোষপাড়া এলাকায় এখন জলাবদ্ধতা হয়। এই দুই এলাকায় লাখখানেক মানুষের বাস।

এই খাল পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকার নতুন করে একটি প্রকল্প নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা অঞ্চলের (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩১৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) গত ২৯ আগস্ট অনুমোদন হয়েছে। এ মাসেই প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে। ২০২৬ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা বড় পরিসরে প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। সে সময় খালের প্রায় তিন কিলোমিটার অংশে ১৮৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর খালে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়। তবে কয়েক বছর পর খালটি আবার ভরাট হতে থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের শেষ দিকে উপজেলা প্রশাসন খালটিকে আগের অবস্থায় ফেরাতে উদ্যোগ নেয়।

তখন ব্যয় হয় ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে এসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে খালের দুই তীরের কিছু অংশে ‘ব্লক’ বসায়।

তখন খালের খনন ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজও হয়। ২০১৬ সালে উপজেলা প্রশাসন দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি ও কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে খালের বর্জ্য অপসারণ করে। তবে এত কিছুর পরও এই খাল বড় অংশই ভরাট হয়ে গেছে। দখল ও দূষণ বন্ধ হয়নি।

শুভাঢ্যা খাল রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই খাল বাঁচাতে বারবার চেষ্টা হয়েছে। টাকাও খরচ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।