রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন
রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন

ভবনটির মূল নকশা নেই, দুই রকমের অনুলিপি

দিনভর তল্লাশি করেও মূল নকশা পায়নি রাজউক। দুটি অনুলিপি পাওয়া গেছে। একটি ৫ তলার, অন্যটি ১০ তলার।

ঢাকার সিদ্দিকবাজারের যে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটি শুরুতে ছিল তিনতলা। ভবনটি কীভাবে সাততলা হলো, সেটার আদৌ রাজউকের অনুমোদন আছে কি না, সেটা এখনো রাজউকের অজানা। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে তল্লাশি করেও এ–সংক্রান্ত নথি পাওয়া যায়নি।

তবে মালিকপক্ষের কাছ থেকে দুই রকম নকশার দুটি অনুলিপি পুলিশ ও রাজউকের হাতে এসেছে। একটি নকশা বলছে, ভবনটি ৫ তলা এবং বাণিজ্যিক। অপর নকশা অনুযায়ী, ভবনটি ১০ তলা।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্র বলছে, ১০ তলার নকশার যে অনুলিপি পাওয়া গেছে, তাতে রাজউকের কোনো সিল বা কারও স্বাক্ষর নেই। ৫ তলা ভবনের নকশার যে অনুলিপি, তাতে রাজউকের অথরাইজড অফিসারের স্বাক্ষর আছে, তাতে তারিখ অস্পষ্ট, সাল ১৯৮৩ লেখা। এটাতে একটা স্মারক নম্বর উল্লেখ আছে।

রাজউকের অথরাইজড অফিসার রংগন মণ্ডল (অঞ্চল-৫/১) জানান, ৫ তলার নকশার অনুলিপিতে যে স্মারক নম্বর আছে সেটা রাজউকের নথি জমা ও অনুমোদনসংক্রান্ত নিবন্ধন খাতায় পাওয়া গেছে। কিন্তু মূল নকশা ও অন্যান্য নথি যে ফাইলে থাকে, সেটি পাওয়া যায়নি। যে কারণে ভবনটির নকশা পরে সংশোধন করা হয়েছিল কি না, তা–ও জানা যায়নি।

স্থানীয় লোকজন জানান, ভবনটি শুরুতে ছিল তিনতলা, পরবর্তী সময়ে সেটি সাততলা করা হয়। বেজমেন্ট থেকে তিনতলা পর্যন্ত ছিল দোকান। চারতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে ঠিক কবে তিনতলা থেকে সাততলা করা হয়েছে, তা গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

* নব্বই দশকে কয়েক দফায় ভবনটি সাততলা করা হয়। * সায়েন্স ল্যাব এলাকার ভবনটির নথিও নেই।

ভবনটির এমন মিশ্র ব্যবহারে রাজউকের অনুমোদন আছে কি না, জানতে চাইলে সংস্থাটির পরিচালক (অঞ্চল-৫) হামিদুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মূল নকশা না পাওয়ায় ভবনটির অনুমোদিত ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। একজন অথরাইজড অফিসারসহ পাঁচ সদস্যের একটি দল মূল নথি খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে।

পরে রাতে সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত নথিটি খুঁজে বের করতে পারেনি।

গত মঙ্গলবার বিকেলে বিস্ফোরণে ভবনটির বেজমেন্ট থেকে দোতলা পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পরদিন ভবনের মালিক ওয়াহিদুর রহমান ও মতিউর রহমানকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাঁদের আরেক ভাই বিদেশে থাকেন। গতকাল তাঁদের ভগ্নিপতিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিতে যায় ডিবি। সেখান থেকে নকশার অনুলিপি দুটি সংগ্রহ করা হয়। পরে সেগুলো যাচাই করার জন্য রাজউককে দেওয়া হয়।

রাজউকে যাওয়া ডিবির কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, মালিকপক্ষের কাছ থেকে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, সেটা হচ্ছে ৯০–এর দশকে কয়েক দফায় ভবনটি সাততলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমান মালিকদের বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় পুরো নির্মাণকাজটি হয়েছে।

এদিকে গত রোববার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেটারও কোনো নথিপত্র রাজউক খুঁজে পায়নি।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণের পরদিন সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে রাজউকের চেয়ারম্যানকে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ভবনটি অনেক পুরোনো হওয়ায় এবং ভবনটির মালিকপক্ষের কাউকে না পাওয়ায় এ–সংক্রান্ত কোনো নথি উদ্ধার করা যায়নি।

ঝুঁকি কমাতে কাজ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে

সিদ্দিকবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির ঝুঁকি নির্ধারণ ও ভবনটি আর ব্যবহার করা যাবে কি না, তা জানতে গত বুধবার ছয় সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করেছে রাজউক। কমিটি সরেজমিনে ভবনটি পরিদর্শন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক ও রাজউকের সদস্য মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, বিস্ফোরণে ভবনটির ২৪টি কলামের মধ্যে সামনের ৯টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ধ্বংসস্তূপ সরানো থেকে শুরু করে যেকোনো কার্যক্রম চালাতে গেলে ভবনটির ঝুঁকি কমাতে হবে। যাতে এটি ধসে না পড়ে। ঝুঁকিমুক্ত করার পর সেখানে প্রকৌশলগত পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করতে হবে। এরপরই বলা যাবে ভবনটি সংস্কার বা মজুবতকরণের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার করা যাবে, নাকি ভেঙে ফেলতে হবে।

বেজমেন্টে দোকান খুঁজতে কমিটি

সিদ্দিকবাজারের সাততলা ভবনের বেজমেন্টেও দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই কোনো আবদ্ধ স্থানে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সাধারণত বেজমেন্ট গাড়ি পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করার অনুমোদন দেয় রাজউক। অনুমোদন ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ।

এমতাবস্থায় রাজউকের আওতাধীন এলাকার ভবনগুলোর মধ্যে কতটি ভবনের বেজমেন্টকে বিপণিবিতান বা দোকান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানতে আটটি কমিটি গঠন করেছে রাজউক। সংস্থাটির আটটি অঞ্চলে এসব কমিটি সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করবে। কমিটিকে ১৬ মার্চের মধ্যে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

দায় কার

নিয়ম অনুযায়ী কোনো ভবনের অনুমোদনহীন ব্যবহার হলে সেটা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। ভবনের অনুমোদনহীন ব্যবহার হলে এবং সেখানে দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কার—সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের পর এই প্রশ্নটি আবারও সামনে এসেছে। এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দায়দায়িত্ব আছে। ভবনের মালিকের যেমন দায় আছে, তেমনি যাঁরা ভবনটিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ দিচ্ছেন, তাঁদেরও দায় আছে।